প্রজন্ম ডেস্ক:
জুলাই-আগস্টের বিপ্লব স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার দ্বার খুলে দিয়েছে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একটি দেশের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকা কতটা জরুরি— এই বিপ্লব তা উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। তাই জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে জনগণের কাঙ্ক্ষিত বিচার বিভাগ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা বিনির্মাণের মাধ্যমে ইনক্লুসিভ জাস্টিস নিশ্চিতকরণে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জবাবদিহিতা ও অপসারণের ফোরাম সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে সরকারের নিকট সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নের নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে যোগ্যতা সম্পন্ন বিচারপতি নিয়োগের জন্য উন্নত বিশ্বের ন্যায় ‘বিচারপতি নিয়োগ’ গঠনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। তার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে অচিরেই স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার অংশ হিসেবে তিনি সারা দেশের বিচারকদের রোডম্যাপ ও কিছু গাইডেন্স দিয়েছেন। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটা হলো শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা তৈরি। যেখানে প্রশাসনের কোনো ভূমিকা থাকবে না। আইন বিভাগের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এছাড়া উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতি উন্নত দেশের আদলে বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এই কাউন্সিল গঠন হলে দলকানা ব্যক্তি বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ পাবে না। স্বাধীনতার এতো বছরে এই উদ্যোগ আশার সঞ্চার করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাশা করি তার হাত ধরে আমরা একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ পাবো।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এর মধ্যে বিচার বিভাগ হলো প্রধানতম প্রতিষ্ঠান। বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নিম্ন আদালতকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। এই জন্য প্রধান বিচারপতি উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে তিনি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। অনেক মিটিং হচ্ছে। আমরা আশা করি এটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের যে নীতিমালা সেটিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিচারকদের যে শৃঙ্খলা বিধি তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি যে সব প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন আমার মনে হয় বিগত ৫০ বছরে যা হয়নি তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বিচার বিভাগে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষ সুফল পেতেই থাকবে। এখানে একটি মামলা পরিচালনা, দুটো মামলার আদেশ দেওয়ার চেয়ে একজনকে জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানো। বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। তার উদ্যোগগুলো যদি বাস্তবায়ন হয় দেশের মানুষ একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ পাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সরকারের অসযোগিতার কারণে এই মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। ফলে বিচারপতি অপসারণের কোনো ফোরাম ছিল না। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে গত ২০ অক্টোবর রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। ফলে পুনরুজ্জীবিত হয় বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। গঠন করা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। কাউন্সিলের অপর দুই সদস্য হলেন- আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারক বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এলে সেই অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র দুইজন বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ওই বিচারপতিকে অপসারণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এরই মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কাজ শুরু করেছে।ছুটিতে পাঠানো ১২ বিচারপতিকে তদন্ত সাপেক্ষে বেঞ্চ দিতে আবেদনবিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা সরকারের কাছে গত ২৭ অক্টোবর বহু কাঙ্ক্ষিত বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের স্বাক্ষরের পর এই প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৭ সালে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। কিন্তু গত ১৭ বছরেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা নেন।
পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির প্রয়োগ ও চর্চার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ কার্যকররূপে বাস্তবায়িত না হলে রাষ্ট্রে সংবিধানের সুসংহত চর্চা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। এর ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে ক্ষমতার সুদ্ধ ভারসাম্য বজায় রাখার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা একদিকে যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রবণতার যে চর্চা অব্যাহত রয়েছে তা রোধ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এর ফলে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা চর্চার সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, দেশের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ দেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ অসম্পূর্ণই থেকে গিয়েছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (যা মাসদার হোসেন মামলা নামেই অধিক সমাদৃত) নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে।
ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে একাধিকবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রসঙ্গ এসেছে। আর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সর্বোত্তম কার্যকর উপায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কারণে উক্ত মামলার রায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমানে প্রচলিত দ্বৈত শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকগণের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
এ কথা সত্য যে, বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্ভবপর হয়নি। এ কারণে বিগত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সময় হচ্ছে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের শ্রেষ্ঠ সময়। এ প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ হতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। কেননা, কেবল পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমাদের দেশে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন বিচার কাজের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি অধস্তন আদালতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তথা হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।
এছাড়া, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সংখ্যা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি, অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মপরিধি পূর্বের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয় স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে কেবল পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতের বিচারকগণের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রস্তুত বিচারকদের বদলি-পদায়নের খসড়া নীতিমালা
গত ৩ নভেম্বর অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়ন নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকদের বদলি ও পদায়নে অভিন্নতা বজায় ও সামঞ্জস্যতা আনয়নের মাধ্যমে দক্ষ বিচার প্রশাসন গঠনের উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে খসড়া প্রণয়ন করা হয়।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন কোনো কর্মস্থলে (আদালত/ট্রাইব্যুনাল) বিচারককে বদলি করা যাবে না যেখানে তার স্বামী/স্ত্রী, পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোন, পিতামহ ও মাতামহ আইন পেশায় নিযুক্ত রয়েছে। এছাড়া সহকারী জজ হিসেবে যোগদানের পূর্বে কোনো আইনজীবী সমিতিতে দুই বছর আইন পেশা পরিচালনা করলে চাকরিতে যোগদানের তারিখ হতে পরবর্তী ১০ বছর উক্ত জেলায় তাকে পদায়ন করা যাবে না। কোনো জেলায় ক্রয়সূত্রে ১০ শতাংশের অধিক কৃষি বা অকৃষি ভূমির মালিক থাকলে উক্ত বিচারককে ওই জেলায় পদায়ন করার সুযোগ নাই।
এই নীতিমালার ওপর বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত সব জেলা ও দায়রা জজ/সমপর্যায়ের বিচারকবৃন্দকে তাদের মতামত লিখিতভাবে ৭ নভেম্বরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তরে পাঠাতে বলা হয়েছে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতে কর্মরত কোনো বিচারক প্রতিটি কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তবে প্রধান বিচারপতির নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, কোনো বিচারক বিশেষ কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন বা কোনো বিচারক বদলি হলে বিচার প্রশাসনে ব্যাঘাত সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে সেক্ষেত্রে উক্ত বিচারক আরও এক বছর উক্ত কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
চৌকি আদালতে কর্মরত বিচারকের পদায়নের মেয়াদকাল হবে সর্বোচ্চ এক বছর। বিচারকদের ফিট লিস্ট ছয় মাস অন্তর অন্তর পরিমার্জন করতে হবে। কোনরূপ ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বিচারকদেরকে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে পালাক্রমে বদলি করতে হবে। কোনো কর্মস্থলে একজন বিচারককে একাদিক্রমে দু’বার বদলি/পদায়ন করা যাবে না। এছাড়া স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ তথা জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পদে পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে প্রস্তুতকৃত ফিট লিস্ট অনুসরণ করতে হবে। মোট চাকরিকালে কোনো বিচারক তিন মেয়াদের বেশি প্রেষণে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বদলি প্রস্তাবের সময় বিচারকের সততা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা বিবেচনা করতে হবে। তবে এই নীতিমালায় যা কিছুই থাকুক না কেন, প্রধান বিচারপতি উপযুক্ত মনে করলে কোনো বিচারকের বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে এই নীতিমালায় বর্ণিত শর্তসমূহ শিথিল করতে পারবেন।
বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল গঠনের কাজ চলমান
গত ২১ সেপ্টেম্বর বিচার বিভাগের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণাকালে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, শুধু বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের জন্য স্বাধীন জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন রয়েছে। যোগ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই কমিশন দরখাস্ত আহ্বান এবং সাক্ষাৎকার নিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে মনোনীত করে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানেও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকার প্রেক্ষিতে সে দেশের উচ্চ আদালত বিচারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে ১৯৯৩ সাল থেকে কলেজিয়াম পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটিয়েছে। তাই উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে অন্যান্য দেশগুলোতে অনুসৃত আধুনিক পদ্ধতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করতে আমি সচেষ্ট হবো। প্রধান বিচারপতি তার কথা রেখেছেন। তিনি এরমধ্যেই বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল গঠনের কাজ শুরু করেছেন। সম্প্রতি ফুলকোর্ট সভায় প্রধান বিচারপতি নিজেই বিষয়টি উচ্চ আদালতের বিচারকদের জানিয়েছেন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com