প্রজন্ম ডেস্ক:
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের চিত্র এখন উঠে আসছে। লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রায় এক ডজন ব্যাংক। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ লাপাত্তা, কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউ ধরা পড়েছেন। ফলে নাজুক এসব ব্যাংক কর্মীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। আবার বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা দিতে না পেরে হেনস্তা ও মারধরের শিকার হচ্ছেন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক খাতে লুটপাট হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি হস্তক্ষেপে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সায় পেয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়েন ব্যাংকগুলোর পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এস আলম বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে নামে-বেনামে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায় আছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোর সব কর্মীর।
গত ৭ নভেম্বর সাভারে ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি শাখায় টাকা তুলতে না পেরে কর্মকর্তাদের আটকে রেখে বিক্ষোভ করেছেন গ্রাহকরা। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় শাখা ব্যবস্থাপক মো. হাসিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা গ্রাহকদের আস্থা হারিয়েছি। আস্থা বাড়াতে হলে গ্রাহককে টাকা দিতে হবে। সেই টাকা আমি দিতে পারছি না। কারণ আমানত জমার পরিমাণ শূন্য। অধিকাংশই তাদের মেয়াদি আমানত মেয়াদ পূর্তির আগেই ভেঙে ফেলছেন। কিন্তু আমি টাকা দিতে পারছি না। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেটা মহাসমুদ্রে দুই ফোঁটা জলের মতো। ব্যাংকার হিসেবে আমরা অভিশপ্ত জীবন পার করছি।’
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় গ্রাহকের টাকা দিতে না পারায় রোষের মুখে পড়েন শাখা ব্যবস্থাপক। অপমানিত হয়ে ভেঙে পড়েন তিনি। পরে নিজের রুমে কান্না করতে দেখা যায় তাকে। এ সময় আহাজারি করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি হালালভাবে চলেছি। কেন আমাদের এই অপমান সইতে হচ্ছে?’
গত ৩০ আগস্ট সিলেট মহানগরের শিবগঞ্জ এলাকার বেসরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংকের হিসাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকার পরেও চাহিদা মতো তুলতে না পারায় গেটে তালা দেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে শাহপরান থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
গত ২ অক্টোবর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় টাকা তুলতে না পেরে হট্টগোল করেন কয়েকজন গ্রাহক। এ সময় হেনস্তার শিকার হন ব্যাংক কর্মকর্তারা। পরে গ্রাহকদের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
টাকা দিতে না পারায় প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মীদের সঙ্গে বাগ্বিত-ায় জড়িয়ে পড়ছেন গ্রাহকরা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদ্মা ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি গ্রাহক যেন ঠিকমতো টাকা পান। যখন গ্রাহকদের টাকা দিতে পারি না তখন সব কথা আমাদের শুনতে হয়। সব ঝড় আমাদের ওপর দিয়ে যায়। অনেকে গালিগালাজ করেন। আমাদের অনেক কিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।’
নাম প্রকাশ না করে আইএফআইসি ব্যাংকের রাজধানীর একটি শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘শাখায় টাকা নেই। প্রতিদিন গ্রাহকরা এসে আমাদের রাগ দেখান। আমাদের কিছু বলার থাকে না। বুঝিয়ে আশ্বাস দিয়ে পার করতে হয়।’
গত ১২ আগস্ট বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, গত ১৫ বছরে ২৪টি কেলেঙ্কারির ঘটনায় লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংক খাতের এমন পরিস্থিতি যারা তৈরি করেছিলেন তাদের অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ব্যাংক খাত ধ্বংসের জন্য অন্যতম অভিযুক্ত সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ব্যাংক খাতে এ ধরনের পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। লম্বা সময় ধরে অনিয়মের মধ্যদিয়ে অনেকগুলো ব্যাংকের অবস্থা খারাপ করে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে অন্যান্য ব্যাংককে তারল্য সাপোর্ট দিয়েছিলাম। এখন আমাদেরই অন্য ব্যাংকের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আতঙ্কে অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। এতে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।’
ইতিমধ্যে ধুঁকতে থাকা এসব ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক এসব ব্যাংককে তারল্য সহযোগিতা দিয়েছে। তবে এসব তারল্য সহায়তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমরা যে তারল্য সহযোগিতা পাচ্ছি সেটাতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। যে পরিমাণ সাপোর্ট দেওয়ার দরকার সেটাতে ঘাটতি রয়েছে। আমরা যদি একসঙ্গে অ্যামাউন্টটা (টাকা) পেতাম এবং গ্রাহকদের চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারতাম তাহলে আতঙ্ক তৈরি হতো না। আস্থার সংকট তৈরি হতো না।’ শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে এবং ব্যাংকগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার জন্য অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। অথচ এই ব্যাংকের চাকরি একটা সময় মানুষের স্বপ্নের মতো ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই অনেক কর্মকর্তাই পেশা বদল করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বিসিএসসহ অন্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একযোগে বেশি গ্রাহক টাকা তুলতে গেলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংকই টিকবে না। কিছু গ্রাহকের আমানতের টাকা উত্তোলনের প্রয়োজন হচ্ছে না। তারপরও অনেক গ্রাহক টাকা তুলতে যাচ্ছেন। ফলে কিছু কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘কিছু ব্যাংকে কর্মীদের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে, তবে সেটা আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কারণে হচ্ছে না। এখন ব্যাংক খাত একটা সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। যার প্রভাব হয়তো কিছু ব্যাংকের ওপর পড়েছে। এটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।’
যেসব ব্যাংকে সব থেকে বেশি লুটপাট হয়েছে তারমধ্যে শীর্ষে রয়েছে এস আলম গ্রুপের দখলে নেওয়া ব্যাংকগুলো। ব্যাংক দখলে নেওয়ার পর পছন্দের মানুষদের শীর্ষ পদে বসাতেন এস আলম। যাদের ছত্রছায়ায় চলত লুটপাট।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কিছু অসৎ কর্মকর্তা অসৎ আচরণকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, যার কারণে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। একদিকে পক্ষপাত করে বিভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যারা অসদাচরণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যেটা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হয়েছেন। যেসব কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে বিভিন্ন অনিয়ম প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল সরকার বলেন, ব্যাংক খাতে অপকর্মের সহযোগী ছিলেন অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে এখানে দুটো বিষয় আছে অনেকেই হয়তো বাধ্য হয়ে এসব করেছেন, আবার অনেকে স্বেচ্ছায় করেছেন। এখন তদন্ত করে বের করতে হবে কারা বাধ্য হয়ে এবং কারা স্বেচ্ছায় অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যারা দুর্নীতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে লুটপাটে জড়িত থাকা শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই নয়। খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লুটপাটে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছেড়েছেন। তবে অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সম্প্রতি এসব কর্মকর্তার অনিয়মের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
চিঠিতে তারা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় তোষণনীতির বিবেচনায় অধিকর্তাদের নিয়োগের কারণে আর্থিক খাতে ভঙ্গুরতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সরকার সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যবসায়িক গ্রুপ ব্যাংক খাত থেকে অনৈতিকভাবে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো আর্থিক খাত। আর এসব কাজে সহায়তা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকা ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) নুরুন নাহার ও ড. হাবিবুর রহমানের অপসারণ দাবি করা হয়েছে চিঠিতে।
Sharing is caring!