প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাপে রেখে একের পর এক পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় বা প্রায় মওকুফ করিয়ে নিচ্ছেন। তবে এত এত শুল্ক ছাড়ের পরও বাজারে তার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ, বাড়তি দামেই নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে তাদের। বেড়েছে গড় মূল্যস্ফীতিও। সরকারি হিসাবেই সাধারণ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সীমাহীন কষ্টে রয়েছেন তারা খাদ্যপণ্য কেনায়। গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল, ডিম ও চাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। একদিকে সরকারের শুল্ক সুবিধা হরদম, অন্যদিকে ভোক্তার পকেট প্রায় ফাঁকা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি আবারও বেড়ে দুই অঙ্কের ঘরে, ১০ দশমিক ৮৭। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। একই সময়ে দেশের মানুষের গড় শ্রম মজুরি বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের গড় আয়ের চেয়ে গড় ব্যয় এখনো ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। আবার গড় আয়ের চেয়ে খাবার কিনতে গড় ব্যয় ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার পর আগে থেকেই ঝুঁকির মুখে থাকা দেশের অর্থনীতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পণ্য বাজারের অস্থিতিশীলতা ছিল তুঙ্গে। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা তলিয়ে যায় উজানে ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলের মাঠ, বিভিন্ন প্রাণীর খামার। ঘাটতি দেখা দেয় সরবরাহ ব্যবস্থায়, যার ফায়দা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। বাজারে কিছু পণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকার পরও কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দিতে সরকারকে চাপে রাখেন ব্যবসায়ীরা। সরকারও তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন পণ্যে শুল্কছাড় দেয়। কিন্তু যে লক্ষ্যে সরকার শুল্কছাড় দিয়েছে, তার কোনো সুফলই পাননি সাধারণ মানুষ। উল্টো ভোক্তার পকেট ছোট থেকে আরও ছোট হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত তিন মাসে গ্রহণ করা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানিতে ছাড়ের ছড়াছড়ি দেখা যায়।
ওই প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার আলু আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা এ দুই পণ্যে শুল্ক সুবিধা নিয়েছেন গত তিন মাসে। অথচ বাজারে গিয়ে সাধারণ ক্রেতারা এই শুল্ক ছাড়ের কোনো সুফল পাননি। উল্টো এ দুই পণ্যের দাম গত তিন মাসে ব্যবসায়ীরা কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়েছেন। আগস্টের ১ তারিখ আলুর দাম ছিল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে, কিন্তু আলু আমদানিতে ব্যবসায়ীরা ১০ শতাংশ শুল্ক ছাড় সুবিধা নিলেও তিন মাসের মাথায় দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কেজিপ্রতি ৭৫ টাকা। যদিও দেশে আলুর উৎপাদন যথেষ্ট রয়েছে।
গত আগস্ট মাসের আগেও পেঁয়াজ আমদানি শুধু ভারতনির্ভর ছিল। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আমদানির বহুমুখী বাজার তৈরি হয়। যার ফল হিসেবে দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে মান ও জাতভেদে কেজিপ্রতি ৪৪ থেকে ৭০ টাকায়ও পাওয়া যায় পেঁয়াজ। এরপরও নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাপে রেখে পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে নেন। ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামানো হয় এ নিত্যপণ্যের শুল্ক। কিন্তু বাজারে এর উল্টো প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আগস্টের শুরুতে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে থাকলেও এখন তা ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ লাখ টন, কিন্তু বর্তমানে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ২৫ লাখ টন। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জনসংখ্যার যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়, ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার সঙ্গে মিল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, ফরিদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলাউদ্দিন খান বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, তখন উৎপাদন ছিল ৪ লাখ টন। তবে বর্তমানে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ টনে। কিন্তু জমি এক ইঞ্চিও বাড়েনি, বরং কমেছে। জনসংখ্যা বাড়ায় চাহিদাও বেড়েছে। তবে জনসংখ্যার সঠিক হিসাব হলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা করা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বীজের চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টনের, কৃষক পর্যায়ে কিছু সংরক্ষণ থাকলেও অধিকাংশই আমদানি করতে হয়। যার বেশিরভাগই আসে চোরাইপথে। চোরাইপথে আসা বীজে মিক্সিং (মিশ্রণ) হয়, ফলে উৎপাদনে সমস্যা হয়। ভালো ফলন হয় না।’
আলু ও পেঁয়াজের মতো একই চিত্র ভোজ্য তেলের বাজারে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে অনুরোধ করে আমদানি শুল্ক কমানোর পর উল্টো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। মূল্য স্থিতিশীল রাখার অজুহাতে ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও অন্যান্য অপরিশোধিত ভোজ্য তেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভোজ্য তেলে মোট ১০ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়।
কিন্তু শুল্ক সুবিধা নিয়ে বাজারে উল্টো ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দর অনুযায়ী, খোলা পাম তেলের লিটার ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকার মধ্যে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে তা ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করছেন। অথচ সরকার স্থানীয় পর্যায়ে দাম না বাড়ানোর শর্তে শুল্ক কমিয়েছিল। এখন ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আবেদন করছেন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা মাথায় রেখে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না।
সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্য ডিমের সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দিলে তাতেও সরকার শুল্ক সুবিধা দেয়। ডিম আমদানির ক্ষেত্রে আরোপনীয় কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০ শতাংশ শুল্কছাড় সুবিধা দেওয়া হয়েছে, অথচ ডিমের বাজারে দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। ডিমের ডজন এখন ১৬০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও গত ১ আগস্ট ডিমের ডজন ছিল ১৫০ টাকা।
ডিম ব্যবসায়ীদের দাবি, কোনোভাবেই ডিমের দাম কমবে না। কারণ উৎপাদন কম, চাহিদা বেশি। জানতে চাইলে ডিম সরবরাহকারী সমিতির সভাপতি তাহের আহমেদ বলেন, ‘যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তার তুলনায় উৎপাদনকারীদের উৎপাদন কম। তাছাড়া গ্রাম এলাকায় অতিমাত্রায় লোডশেডিংয়ের কারণে ডিমের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ গেলে সাধারণত মুরগি ডিম পাড়তে চায় না। ডিমের দাম সহসাই কমছে না।’
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা : গত ৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে বলে সাপ্তাহিক হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম তেলের দাম বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত সয়াবিনের দাম ৮ টাকা বেড়ে লিটারে ১৩৫ টাকা হয়েছে, এক সপ্তাহ আগে তা ছিল ১২৭ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত পাম তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে ১৪০ টাকা ৫৯ পয়সা হয়েছে। একইভাবে পেঁয়াজের দাম ১৬ টাকা বেড়ে ৭৬ টাকা হয়েছে।
আবার আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দামও কমেছে। চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা ৮২ পয়সা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৯ টাকা ৩০ পয়সায়, পরিশোধিত চিনির দাম ১ টাকা ১৩ পয়সা কমে দাঁড়িয়েছে ৬০ টাকায়, মসুর ডালের দামও কেজিতে কমেছে প্রায় ৪ টাকা। সবচেয়ে বেশি কমেছে রসুনের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি রসুনের দাম কমেছে ৩৫ টাকা।
বাজার ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় খাদ্যপণ্যের দামে খেয়াল রাখতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এটার খুব যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন সরকার বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা ইতিমধ্যে বিভিন্ন কমিটি করে দিয়েছেন। যাদের মূল লক্ষ্য বাজার মনিটরিং করা, এটার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটি ততক্ষণ পর্যন্ত ইফেকটিভ (কার্যকর) হবে না যতক্ষণ না বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ আমরা দূর না করতে পারি।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘মনিটরিং করে মূল্য বেঁধে দিতে পারেন। বাজারে পণ্যের মূল্য কতটুকু হবে এটি নির্ভর করে যারা উৎপাদনকারী তাদের ওপর। ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের একটি সরবরাহ চেইন থাকে। এখানে উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী, মজুদদার, মিলমালিকসহ বিভিন্ন হাত ব্যবহার হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে যায়। এখানে অনেক মধ্যস্বত্বভোগী থাকে।’
বাজার নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাশালীদের প্রভাব থাকে উল্লেখ করে মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে কেউ যদি ক্ষমতাশালী থাকে, সে যদি তার সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তখন সে সেটিকে ব্যবহার করে মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করে। এখানে সিন্ডিকেট বলতে কিছুই নেই, তারা নিজেরা যোগসাজশ করে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এখন খুঁজে দেখতে হবে পণ্যের মূল্য বাড়ানোর পেছনে অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী কারা। সেটি বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক ও দক্ষ করতে না পারলে শুধু বাজার তদারকি ব্যবস্থা দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ মোহাম্মদ আফছার খান সাদেক
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মিলাদ মোঃ জয়নুল ইসলাম
প্রকাশনালয়ঃ রিপোর্টার লজ, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ উত্তর বাজার কেন্দ্রিয় মসজিদ মার্কেট (২য় তলা), বিয়ানীবাজার, সিলেট ।
মোবাঃ ০১৮১৯-৬৫৬০৭৭, ০১৭৩৮-১১ ৬৫ ১২
ইমেইলঃ agamiprojonma@gmail.com, milad.jaynul@gmail.com