প্রজন্ম ডেস্ক:
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা। বিশেষ করে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতন এবং পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের অন্ধ সমর্থন এখনো বহাল। দিল্লি ডান-বাম না দেখে গত ১৫ বছর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনেই ভরসা রেখেছে। হাসিনার শাসনামলে নানা ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন ছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বে।
সাপ্তাহিক রাজনৈতিক ম্যাগাজিন জনতার চোখে মিজানুর রহমানের প্রকাশিত এক রচনায় বিষয়টি উঠে আসে।
যেখানে বলা হয়- গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষের বাক- স্বাধীনতা তথা ভোটের অধিকার হরণের সমালোচনা ছিল দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু ভারত শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষেই থেকেছে। একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশকে হারানোর ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি ভারতের (বাইপার্টিজান) নেতৃত্ব। সীমান্তে গুলি-হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখনো ঘটছে। কিন্তু আগে বেশির ভাগ গুলি হতো চোরাকারবারিদের টার্গেট করে। নিরীহ শিশু-কিশোর কিংবা নারীকে হত্যার ঘটনা ফেলানী ছাড়া বিরল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সীমান্তে সংঘটিত দু’টি লোমহর্ষক ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় দূতকে তলব করা হয়েছে। এটাও নজিরবিহীন। উভয় সরকারের বক্তৃতা-বিবৃতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সরকারি চিঠিপত্রে বেশ শক্ত ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। এ সবই দু’দেশের সম্পর্ক তিক্ততার চরমে পৌঁছার ইঙ্গিত। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যও ভালোভাবে নিচ্ছে না ভারত। তারা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় ভিসা কার্যক্রম শিথিল রেখেছে। এতে অনেক বাংলাদেশি জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশটির ঋণে বাংলাদেশে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। কর্মীরা কাজে যোগদানে অনীহা দেখাচ্ছেন। যদিও এ নিয়ে দিল্লিকে দফায় দফায় অনুরোধ করে চলেছে ঢাকা। এই যখন অবস্থা তখন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়েছে উভয়ের বন্ধুরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থন রয়েছে। অনেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পেছনে ওয়াশিংটনের ভূমিকা থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের তরফে কখনোই তা স্বীকার করা হয়নি।
বরং বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বা বাইরের শক্তি নয়, বাংলাদেশের মানুষই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ‘রেজিম চেঞ্জ’ করেছে। এটা অস্বীকারের জো নেই যে, আওয়ামী শাসনে দেশের বেশির ভাগ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। খোদ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও। তারা পরিস্থিতির পরিবর্তন চেয়েছিলেন।
তবে শেখ হাসিনার এমন শোচনীয় পরাজয় চাননি। দেশত্যাগ তো নয়ই। সমালোচনা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি বন্ধু-উন্নয়ন অংশীদারদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের গত ৩টি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সমর্থনই কাল হয়েছে ভারতের। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় ছিল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আর ভারত বিরোধিতাকে সমার্থক বানিয়ে প্রচার! শেখ হাসিনা সরকার তার গদি ধরে রাখতে ভারত বিরোধিতাকে ‘কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করেছে যথেচ্ছ ভাবে।
যা সরকারের পাশাপাশি ভারতের প্রতি মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। এটা বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতাকে উস্কেই দেয়নি বরং ‘নতুন মাত্রা’ দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে নানা মিথ রয়েছে। এক সময় বলা হতো দিল্লির চোখেই বাংলাদেশকে দেখে যুক্তরাষ্ট্র! এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠে ট্রাম্প জমানায়। সেই সময়ে রিপাবলিকান সরকারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকা আসার আগে তিনি দিল্লিতে ছিলেন ৩ দিন। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের শক্ত উপস্থিতি বোঝাতে গিয়ে দিল্লিতে দেয়া বক্তৃতায় বিগান ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ অর্থাৎ ‘হাতি ঘরে ঢুকে গেছে’- এমন শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। ঢাকায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিগান এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চায়। অন্য দেশের মাধ্যমে নয়। সেদিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সেন্টার পিস বা কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়টিও খোলাসা স্টেট ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা কর্মকর্তা স্টিফেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওয়াশিংটন নিজের লেন্সে ঢাকাকে দেখলেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় বাংলাদেশ নিয়ে কথা হবে- এটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। এ অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে ‘কোয়াড’ নামের চতুর্দেশীয় যে জোট রয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত সহযোগী ভারত। সামরিক ওই জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে পেন্টাগন এবং দিল্লির চাওয়া অভিন্ন। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দফায় দফায় তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো দূতিয়ালি করছে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে উচ্চ পর্যায়ের একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল। ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু। বাংলাদেশ সফরের আগে ৩ দিন তিনি দিল্লিতে কাটান। ঢাকা সফর শেষ করে দিল্লি হয়েই ওয়াশিংটন ফিরেন। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে নতুন সরকারের আমলে এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম সফর। ওই সফরকে ঘিরে শুধু ঢাকা, ওয়াশিংটনই নয়, দিল্লিসহ কূটনৈতিক মহলে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। বিশেষ করে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভূমিকা রয়েছে মর্মে প্রচার থাকা কূটনীতিক ডনাল্ড লু’র দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসা এবং কী বার্তা বিনিময় করছেন তাতে আগ্রহ ছিল সবার। কিন্তু তখনো বিষয়টি পুরোপুরি খোলাসা হয়নি। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, ডনাল্ড লু’র বার্তা বিনিময়ের রেশ ধরেই জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে বসেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রী। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং নতুন পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের বৈঠকও সেই প্রক্রিয়ার অংশ।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেন আর অবনতি না ঘটে বরং এটি দিনে দিনে স্বাভাবিক এবং উন্নত হয়, সেই দূতিয়ালি করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘শেখ হাসিনা’ এখন বড় ইস্যু। সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ঢাকা-দিল্লি যেসব বৈঠক হয়েছে তার কোথাও শেখ হাসিনার স্ট্যাটাস বা অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দু’পক্ষই বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইস্যু যাই থাক, সম্পর্কের স্বার্থে যেনো তা যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া যায়। এটাই উভয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের বার্তা।
স্মরণ করা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা বিশেষ করে কোনো ইস্যুতে যেনো দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের ভুল বুঝাবুঝি না হয় সে বিষয়ে বরাবরই সতর্ক যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার যখন নিজের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় তখন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান ডব্লিউ মজিনা। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন ম্যাকানিজম বের হোক যার অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। জাতিসংঘ তৎপর ছিল সেই মধ্যস্থতায়। জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় সরকার ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে এক টেবিলে তিন দফা বৈঠক করেছিলেন। পশ্চিমা ওই প্রক্রিয়ায় ভারতের সমর্থন আদায়ে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে দিল্লি পাঠিয়েছিল তৎকালীন ওবামা প্রশাসন। কিন্তু ভারত সেদিন শেখ হাসিনার ছকেই নির্বাচনের পক্ষে সায় দেয়। দিল্লির বিদেশ সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে উড়ে এসে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ’১৮-র নির্বাচনে ভারতের মধ্যস্থতায় অংশ নেয় বিরোধী জোট। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন। বলাবলি আছে ওই নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারলে ৭০-৮০ আসনে জয় পেতো। কিন্তু লাভ হয়নি, দিনের ভোট রাতেই হয়ে গেছে।
২০২৪ সালে ফের একপক্ষীয় নির্বাচন আয়োজন করে শেখ হাসিনা সরকার। যুক্তরাষ্ট্র ওই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিল। তারা নির্বাচনটি ফেয়ার করতে আগাম ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। পশ্চিমা দুনিয়ার অনেকেরই মার্কিন অবস্থানের সঙ্গে সহমত ছিল। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো এবার চাপে পড়ে হলেও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের দিকে যাবে হাসিনা সরকার। কিন্তু না, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরের পর এবং দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের ঠিক আগে আগে ভারত ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর রটে এবারো নির্বাচনে ভারতকে পাশে পাচ্ছেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠানো দিল্লির কূটনৈতিক বার্তার বরাতে কলকাতার আনন্দবাজার ও জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে কাছাকাছি সময়ে প্রায় অভিন্ন সংবাদ প্রচার করে। সংবাদ দু’টির ভাষ্য ছিল এমন- নয়াদিল্লি মনে করছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কারও জন্যই সুখকর হবে না। ভারতও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চায় জানিয়ে পাঠানো বার্তায় নয়াদিল্লি বলে, হাসিনা সরকারকে অস্থির করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক নয়। রিপোর্ট দু’টিকে রেফারেন্স ধরে সেদিন ঢাকার মিডিয়াতে শোরগোল তুলে আওয়ামী লীগ। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিল্লিতে পৌঁছেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন তিনি। বৈঠকে অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ হয়েছে বলে নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান নরেন্দ্র মোদি। সেই সঙ্গে আগামীতেও সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেন তিনি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে পঞ্চম প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ‘টু প্লাস টু বৈঠক’ হয়।
সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এবং ভারতের পক্ষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর নিজ নিজ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং এটাকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। যা প্রকাশ করেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। বলা হয়, বৈঠকে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ‘পরিষ্কারভাবে’ তুলে ধরেছে। সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী কী বলেছিলেন তা আজও প্রকাশ হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে এমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চেয়েছে যেখানে সাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে তা তারা ভোটের রাত পর্যন্ত বলে গেছে। সেই বৈঠকের সূত্র ধরে আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেই সময় এক নিবন্ধে লিখেন- ‘এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানে ভিন্নতা আছে। ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি যে সরকারই থাকুক, তাদের জন্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার থাকাই সুবিধাজনক। সেদিন তিনি বলেন- সাধারণ স্বার্থবোধ থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করেছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সংঘাতও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে এ মুহূর্তে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরস্পর থেকে দূরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার মূল্যায়ন ছিল- বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থান বিরোধাত্মক হলেও তা সংঘাতে যাবে না। বাস্তবে হয়েছেও তাই। নির্বাচনের পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে এদেশের সাধারণ ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মুহূর্তেই আগ্নেয়গিরিতে রূপ নিয়েছে। রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে শেষ পর্যন্ত পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। সেটিও আবার ভারতেই। প্রায় আড়াই মাস হতে চললো, তাকে এখনো দেখা যায়নি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার কোনো ছবি ‘লিক’ হয়নি। কথিত ফোনালাপের অডিও ফাঁস হলেও সেগুলো যে তারই কণ্ঠস্বর তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। বিবিসি’র ভাষ্য মতে, ভারতে এসে কার্যত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন তিনি! দিল্লিতে নামার পর থেকে কীভাবে, কোথায় আছেন- তা নিয়ে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি। তিনি ভারত ছেড়ে গেছেন মর্মে আলোচনার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি দিল্লি এটুকুই জানিয়েছে যে, তিনি এখনো ভারতেই অবস্থান করছেন। বিবিসি’র রিপোর্ট মতে, ভারতের চোখে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা একজন ‘গেস্ট, বাট আন্ডার কমপালশন!’ অর্থাৎ ‘তিনি রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত অতিথি’- যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নিজ দেশ ত্যাগ করে চলে আসতে হয়েছে। নেপালের মহারাজা ত্রিভুবন নারায়ণ শাহ, আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ এবং তিব্বতী ধর্মগুরু দালাই লামা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। ’৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর শেখ হাসিনাও ’৮১ সাল পর্যন্ত ভারতে ছিলেন। তখনো সেটি কাগজে-কলমে ‘অ্যাসাইলাম’ ছিল না। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট মতে, শেখ হাসিনার জন্য দিল্লিই একমাত্র বিকল্প। ভারত সরকার তাকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে কিন্তু বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া তার জন্য সহজ নয়। বৃটেনের দরজাও বন্ধ। প্রথম কারণ টেকনিক্যাল, বৃটেনে থেকেই শুধু আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা যায়, বাইরে থেকে নয়। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো রাজনৈতিক। হাসিনাকে আশ্রয় দিলে ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে শুরু হবে দারুণ অশান্তি। লেবার পার্টির বাংলাদেশি সমর্থকেরা হয়ে যাবেন দু’-ভাগ। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার চাইছেন না হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে কোনো গণ্ডগোলের সূত্রপাত করতে। তাছাড়া বাঙালি বংশোদ্ভূত পার্লামেন্ট সদস্যরাও চাইছেন না হাসিনা সেখানে যান। রুপা হক এ নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী এখন ওখানকার কেবিনেট মিনিস্টার। তিনি নিজেকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছেন। সব মিলিয়ে টিউলিপও সম্ভবত খালাকে দূরে রাখতে চাইবেন। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষোভ সীমাবদ্ধ ছিল শেখ হাসিনার একনায়কত্বের বিরুদ্ধে। ভারত-বিরোধী তৎপরতা আন্দোলনের সময় ছিল না বললেই চলে। যদি হাসিনার পক্ষ নিয়ে ভারত কিছু করতে যায় বা বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা আরও তীব্র রূপ নিতে পারে। ড. ইউনূস সরকারপ্রধান হওয়াতে ভারত সরকার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে। ভারত ড. ইউনূসকে যথেষ্ট সম্মান করে। নোবেল বিজয়ের পর শেখ হাসিনা সরকারের রোষানলে থাকা অবস্থাতেই তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের যৌথ সভায় বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান। বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত ভারত নিশ্চিন্ত। তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে স্বভাবতই তাদের উদ্বেগ রয়েছে। থিঙ্কট্যাংক, সাউথ এশিয়া মনিটরের বিশ্লেষক সি. উদয় ভাস্করের মতে, ভারতে আশ্রয়ে থেকে হাসিনা কী করতে চাইবেন? আর ভারতও বা তাকে দিয়ে কী করাতে চাইবে? সেটি এখন বড় প্রশ্ন। তবে এটা অনুমেয় যে, আপাতত ভারত তার মাটিতে বসে হাসিনাকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে দেবে না।
হাসিনার ভারতে অবস্থান যদি ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে কোন ছায়া ফেলে তা কারও জন্যই সুখকর হবে না। কারণ ঢাকাকে দিল্লির দরকার। আবার ঢাকারও দিল্লিকে দরকার। সেই বিবেচনায় এটা আশা করা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনা বিদেশে চুপচাপ অবসর জীবন কাটাবেন। তবে যারা হাসিনাকে চেনেন বা তার প্রতিহিংসার ভাষা সম্পর্কে জানেন, তারা নিশ্চয়ই বলবেন- হাসিনাকে ‘চুপচাপ’ রাখা হয়তো দিল্লির জন্য সহজ হবে না।
Sharing is caring!