প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : মিয়ানমারের নতুন ‘কূটকৌশল’ নয় তো!

editor
প্রকাশিত এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : মিয়ানমারের নতুন ‘কূটকৌশল’ নয় তো!

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সম্ভাবনা জাগিয়ে দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকার। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পর আবারও আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

 

মিয়ানমারের নতুন এ বার্তা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা প্রত্যাবাসন শুরুর ক্ষেত্রে আশার আলো হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে, গত কয়েক বছরে মিয়ানমারের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। সেখানে আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের অধিকাংশ এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। জান্তা সরকারও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়টি এখন আর শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয় নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তারা বলছেন, মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বেশ দুরূহ হয়ে পড়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হবে। তবে, এ আলোচনা দ্বিপক্ষীয় পদ্ধতিতে এখন আর সম্ভব নয়। এখানে মিয়ানমার সরকারকে যেমন যুক্ত থাকতে হবে, তেমনি দেশটির আরাকান আর্মিকেও রাখতে হবে। রাখতে হবে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে।

 

স্থানীয় কূটনীতিকেরা বলছেন, মিয়ানমার জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত আট লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য। প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে এ কথা বলেছেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী উ-থান শোয়ে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে শুক্রবার বৈঠক করেন তারা।

২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছে নেপিদো। আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ও ছবি চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে। এ ছাড়া, আরও সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই জরুরিভিত্তিতে করবে বলেও আশ্বস্ত করেছে জান্তা সরকার।

 

এখন প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার জান্তার এবারের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখা যায় কি-না? কারণ, জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করবে কোথায়? রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু, বুথিডং, রাথিডং শহর তো তাদের দখলে নেই। রাখাইন রাজ্যের বাকি অংশ থেকেও জান্তা নিজেই বিতাড়িত।

 

 

আরাকান আর্মিকে এড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কি সম্ভব? প্রত্যাবাসনের আলোচনায় আরাকান আর্মি কি যুক্ত? যদি তাদের যুক্ত করা হয় সেই দায়িত্ব কি মিয়ানমার বা বাংলাদেশ নেবে? এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিবের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে দেওয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরকান আর্মির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে আরকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন।

এটি এখন মোটামুটি স্পষ্ট যে, বাকি মিয়ানমারে যা-ই ঘটুক, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনস্থল রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এবং আগামী কয়েক বছরে আরাকান আর্মিই প্রধান অনুঘটক। মিয়ানমারের জান্তা নয়, আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।

ব্যাংককভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ সংস্থা ইরাবতী গত ৪ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্য সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্য জিন মার অং বলেছেন, ব্যাংকক সম্মেলনে জান্তার অংশগ্রহণ বিমসটেক সনদের লঙ্ঘন। কারণ, তারা মিয়ানমারের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়।

 

মিয়ানমারকে নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা স্থানীয় কূটনীতিকেরা বলছেন, দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের খুব কাছাকাছি গিয়েও হোঁচট খেতে হয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের দিক থেকে বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করা হলেও প্রকৃত অর্থে জান্তা সরকারের কোনো আন্তরিকতা ছিল না। দেশটির সরকার বরাবরই ‘কূটকৌশল’ গ্রহণ করেছে। তবে, বিপদটা আমাদের। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান একই আছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

এদিকে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি দেশটির আরাকান আর্মির সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ সরকার। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে খলিলুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। দেশের সীমান্ত সুরক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের স্বার্থে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ দখল করে থাকা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা।

 

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির এমন বক্তব্যের মাসখানেকের ব্যবধানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সুখবর দেয় জান্তা সরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের খবর পেয়ে কি নতুন কোনো কৌশল সামনে আনল জান্তা সরকার; নাকি তৃতীয় কোনো বন্ধুরাষ্ট্রের পরামর্শে নতুন কূটকৌশল এটি, তা হয়তো সামনের দিনগুলোতে খোলাসা হবে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব চীনের। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দেশটির সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আরাকান এলাকায় বিভিন্ন পক্ষ এখন দায়িত্বপালন করছে। তাদের মধ্যে রয়েছে- বিদ্রোহী আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সরকার ও চীন। সেখানে রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ, যার প্রতি চীনের আগ্রহ বেশ। এ ছাড়া, পরাশক্তিদের কেউ কেউ মিয়ানমারের রাখাইনে তাদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। তবে এটি স্পষ্ট যে, যেকোনো মূল্যে মিয়ানমার বা রাখাইনে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে চাইবে চীন। সে জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার বিরোধী।

জানতে চাইলে চীনে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের পর যে তালিকা দিয়েছে, সেটি ইতিবাচক। তবে, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে আরাকান আর্মির মনোভাব বোঝাটা জরুরি। রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। জান্তা সরকার এখানে বেশ দুর্বল। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হলে ওই যাচাই তালিকা বাস্তবায়নযোগ্য হবে।’

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে প্রক্রিয়া সেই আলোচনা আমরা শুরু করেছি। আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা শুরু করছি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, এটা তাদের একটা প্রিন্সিপাল পজিশন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আলোচনা হয়েছে। এবারের আলোচনায় আবারও সেটি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা মনে করি, এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত আমরা করতে পারব, তবে সময় লাগবে।’

‘এটা তো কালই হচ্ছে না, তবে দ্রুত সময়ে যাতে হয় সেই প্রচেষ্টা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, আগামী ইফতার (আগামী বছরের রমজান) তারা দেশে গিয়ে করবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য।’

 

এখানে উল্লেখ্য যে, চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। দেশে ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। এরপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

 

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আট লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে আরও অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা। নতুনভাবে এখনও রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছেন। অন্তত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা গত কয়েক মাসে নানাভাবে বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের মধ্যে ৫৬ হাজার জনকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া, প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।

 

 

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের একটি ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় আট লাখ দেখানো হয়েছে। তারা মিয়ানমারের কোন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন, সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকা বাংলাদেশ আগেই মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। দেশটি এ তালিকা যাচাই করে পর্যায়ক্রমে তা নিশ্চিতও করেছে।

Sharing is caring!