
প্রজন্ম ডেস্ক:
দুর্নীতি আর নানা অনিয়মের কারণে দুদক অনেক পতিত প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে, কিন্তু প্রায় সবক্ষেত্রেই এরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পট পরিবর্তনের পরপরই পাল্টে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।
সংস্থাটি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের কারও না কারও বিরুদ্ধে মামলা করছে। কিন্তু মামলা হলেও প্রভাবশালী রাঘববোয়ালরা রয়েছেন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, অস্বাভাবিক লেনদেন, দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলায় রয়েছেন কারাগারে। দুদকের তথ্য বলছে, পতিত সরকারের আমলে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, আয়কর ফাঁকি ও সম্পদের তথ্যে গরমিল, ঘুষগ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের সদস্যরা।
এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন, সাবেক মন্ত্রী টিপু মুনশি, ডা. জাহিদ মালেক, নসরুল হামিদ বিপু, ডা. এনামুর রহমান, তাজুল ইসলাম, ইমরান আহমেদ, জাকির হোসেন, মো. শাহাব উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
এ ছাড়া সাবেক এমপিদের মধ্যে রয়েছেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, বেনজির আহমেদ, এ কে এম সারোয়ার জাহান, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, শহিদুল ইসলাম বকুল, শেখ আফিল উদ্দিন, ছলিম উদ্দিন তরফদার, কাজী নাবিল আহমেদ, এনামুল হক, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, মহিবুর রহমান, মেহের আফরোজ চুমকি, কাজিম উদ্দিন, স্বপন ভট্টাচার্য এবং নূরে আলম চৌধুরী। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বনে যাওয়া ও সেখান থেকে লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ার পর মামলা হলেও তাদের টিকিটি ছুঁতে পারছে না সংস্থাটি।
অন্যদিকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, গোলাম দস্তগীর গাজী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক এমপি হাজি মোহাম্মদ সেলিম ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এ ছাড়া ইতিমধ্যে ৭৪টি আদেশে অভিযুক্তদের দেশে থাকা স্থাবর-অস্থাবর ১০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ও বিদেশে থাকা ১৬৫ কোটি টাকার সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া অর্থ পাচারের অভিযোগে গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৬৬ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। ১১২টি মামলার বিপরীতে এই ব্যাংক হিসাবগুলো জব্দ করা হয়েছে। এ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হিসাব জব্দ করতে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করে বিএফআইইউ। সন্দেহজনক লেনদেনসহ প্রায় ২২৫টি তদন্ত প্রতিবেদন আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে চিঠি পাঠানো হয়। জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, হাসিনার বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের হিসাবও রয়েছে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, তার ছেলে শায়ান ফজলুর রহমান ও তার স্ত্রী, আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং সিআরআইয়ের ‘ইয়াং বাংলা’ প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এই তালিকায় আরও রয়েছে সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপের মালিক ও প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যাংক হিসাব। যাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে তাদের মধ্যে আর আছেন এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল, এনআরবিসি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম, ইউনিয়ন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরী, পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩ হাজার ৬৬টি। এরমধ্যে বিচার চলমান মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৩০। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলার সংখ্যা ২৩৬। ১৯টি মামলায় সাজা হয়েছে। মামলা খালাস পেয়েছে ২০টি। মোট নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা ৩৯টি। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিচার চলমান মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৩৩। উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত মামলার সংখ্যা ২৩৬। মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩ হাজার ৬৯। এরমধ্যে সাজা হয়েছে ৮টি, আর খালাস দেওয়া হয়েছে ৮টি মামলা। গত জানুয়ারি মাসে মামলার মোট নিষ্পত্তির হার শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে মোট মামলা হয়েছে ৭৭৩টি। ওই মাসে মাত্র ৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৬টি। এরমধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলার সংখ্যা ২৩৭টি। আর বিচার চলমান রয়েছে ২ হাজার ৮২৯টি মামলার।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পতিত সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই দুদক মামলা করেছে বেশি। এখনও পতিত সরকারের অনেক রাঘব বোয়াল ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করছে। ইতিমধ্যে ১৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য ও গত সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এরমধ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া ১ হাজার ৮৯৪টি অভিযোগের। এ ছাড়া সংস্থাটির তফসিলভুক্ত অপরাধ না হওয়ায় ৬ হাজার ৭৬৭টি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। তবে ৪৯৫টি অভিযোগ বিভিন্ন দফতরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে।
দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিসহ রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রভাবশালী অন্তত ২০০ জনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে দুদক। ইতিমধ্যে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও অনেকেই বিদেশে পালিয়ে থাকায় ধরা যাচ্ছে না। আবার কেউ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও তদবির করছেন। সংগত কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তবে যে যত বড়ই শক্তিশালী হোক না কেন, তারা রেহাই পাবেন না। দুদক কারও দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জনগণ প্রত্যাশা করে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি না করাতে পারলে ভবিষ্যতে দুর্নীতিতে অনেকে উৎসাহিত হবে। এটি না হলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, আয়কর ফাঁকি ও সম্পদের তথ্যে গরমিল, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, কেনাকাটায় দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার ও ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে মামলা করেছে দুদক। এখন আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
Sharing is caring!