
প্রজন্ম ডেস্ক:
গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরে জেল পলাতক ৭ শতাধিক আসামির এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এখনও উদ্ধার করা যায়নি কারাগার থেকে লুণ্ঠিত বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র। আসামি গ্রেফতার কিংবা অস্ত্র উদ্ধারেও নেই কোনো অগ্রগতি। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জেল পলাতক এসব আসামি ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যবহার হতে পারে লুণ্ঠিত অস্ত্রও।
৫ আগস্টের আগে ও পরে দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ৫টিতে জেল ভেঙে বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এগুলো হচ্ছেÑনরসিংদী, সাতক্ষীরা, কাশিমপুর, কুষ্টিয়া ও শেরপুর কারাগার।
কারাগার থেকে পলাতক প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। দেশের প্রতিটি থানাকে তাদের বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। এ ছাড়া পলাতকদের বিষয়ে প্রতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকেও জেল পলাতকরা যাতে দেশত্যাগ না করতে পারে সে জন্য বলা হয়েছে।
গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার কারা অধিদফতরে কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী সহিংসতা ও সরকার পতনের উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা-বিদ্রোহ করে। বাইরে থেকেও কোনো কোনো কারাগারে চালানো হয় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। এই পরিস্থিতিতে কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়। যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতারের পর আবারও কারাবন্দি করা হয়েছে। তবে এখনও ৭০০ বন্দি পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী, ৭০ জন জঙ্গি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও আছে। ওই সংবাদ সম্মেলনের চার মাস পেরিয়ে গেলেও পলাতক বন্দিদের সংখ্যা এখনও ঠিক একই আছে।
এ প্রসঙ্গে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, মাঝেমধ্যে দুয়েকজন গ্রেফতার হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর অগ্রগতি খুবই কম। কারাগার থেকে লুণ্ঠিত ১৬টি অস্ত্রের এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ৫ আগস্টের আগে ও পরে ২ হাজার ২ শতাধিক কয়েদি জেল ভেঙে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ১ হাজার ৫ শতাধিক আত্মসমর্পণ করে কিংবা গ্রেফতার করা হয়। এখনও ৭ শতাধিক নিখোঁজ আছে। পলাতক সবার বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। তারা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকেও তালিকা দেওয়া হয়েছে।
কারাগারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশের যেসব কারাগার থেকে বন্দি পালিয়েছে, তার প্রতিটি ঘটনা আমরা তদন্ত করেছি। সেখানে আমাদের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা, কারাগারের বাইরের নিরাপত্তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তায় ত্রুটি পাওয়া গেছে। প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বসহকারে প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কাশিমপুর কারাগার থেকে ৫ আগস্টের পর ২০২ জন পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ফিরে আসে ৫৪ জন। পলাতকদের মধ্যে ফাঁসির আসামি ছিল ৮৮ জন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিল ১১ জন, বিচারাধীন হাজতি ছিল ১০৩ জন। এই কারাগার থেকে পলাতক ১৪৮ জন এখনও অধরা আছে। তবে কাশিমপুর কারাগার থেকে পলাতকদের মধ্যে কোনো জঙ্গি ছিল না বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. মনির হোসেন বলেন, জেল ভেঙে পালিয়ে যায় ৫৯৬ জন বন্দি। এর মধ্যে ৫০৯ জন আত্মসমর্পণ করে। বাকি ৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরবর্তী সময়ে ৪০ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এখনও পলাতক আছে ৪৭ জন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রথম বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটে ১৯ জুলাই নরসিংদীর কারাগারে। এই ঘটনায় জেল সুপারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। এই ঘটনায় ২০১ জন কারারক্ষী আহত হয়েছিল। পাশাপাশি কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তাদের বাসভবনেও হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় কারাগারের ৮৫টি অস্ত্র লুট হয়েছিল।
নরসিংদী কারাগারের জেল সুপার শামীম ইকবাল বলেন, গত ১৯ জুলাই এই কারাগার থেকে ৮২৬ জন পালিয়ে যায়। এর মধ্যে আত্মসমর্পণ ও গ্রেফতার করা হয় ৬৯০ জনকে। আত্মসমর্পণকারী দুই নারী জঙ্গি পরবর্তী সময়ে জামিন পান। এখনও ১৩৬ জন পলাতক আছে।
কুষ্টিয়া ও শেরপুর কারাগারের জেলার কিংবা জেল সুপার ফোন রিসিভ না করায় তাদের কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পলাতক এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেশের ভেতর এবং বাইরের সক্রিয় গোষ্ঠীগুলো পলাতক এসব বন্দিদের ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের উত্থানের আশঙ্কা করা হয়। যদিও সেই প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, যেহেতু এদের এতদিনেও গ্রেফতার করা যায়নি, তার অর্থ হচ্ছে তাদের শক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের সেই ধরনের নেটওয়ার্ক আছে বলেই তারা এখন পর্যন্ত আত্মগোপনে আছে। যেকোনো বৈধ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সক্ষমতাও তাদের আছে। পলাতক বন্দিদের সহজ মনে করার কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে ড. তৌহিদুল হক বলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের সেই সক্ষমতা কিংবা শক্তি নেই বলেই তারা তা করেছে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের শক্তির জানান দিতে পলাতক এসব বন্দিদের ব্যবহার করা হতে পারে। আবার বাংলাদেশকে বৈশ্বিকভাবে ‘উগ্র’ হিসেবে দেখানোর যে ষড়যন্ত্র চলছে সেই ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রেও তাদের ব্যবহার করা হতে পারে।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, সাধারণত অপরাধের শীর্ষ পর্যায়ে যারা থাকে তাদের দিয়েই বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত করা হয়। যেহেতু জেল পলাতক এসব বন্দি এখনও অধরা আছে কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে শক্তিমত্তা ও নেটওয়ার্কগত দিক দিয়ে তারা বেশ শক্ত অবস্থানে আছে। কাজেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব এদের গ্রেফতার করা। একই সঙ্গে তাদের অতীত রেকর্ড পর্যালোচনা করে সেই নেটওয়ার্ককে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা।
Sharing is caring!