
প্রজন্ম ডেস্ক:
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব দুস্থ, গরিব সুবিধাভোগী মাসিক ভাতা পাচ্ছেন, তাদের জন্য সুখবর আসছে। আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের বাজেটে তাদের মাসিক ভাতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আওতা। যদিও বাড়ার অঙ্ক খুবই কম। সর্বনিম্ন ভাতা বাড়ছে ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। গত দুই অর্থবছরে শুধু আওতা বাড়লেও বাড়েনি ভাতা। এবার আওতা ও ভাতা দুটিই বাড়ছে। অর্থ ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সবচেয়ে বড় দুটি কর্মসূচি হচ্ছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা। আসন্ন বাজেটে এই দুটি কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ভাতার অঙ্ক। দেশে এখন ৬০ লাখ ১ হাজার সুবিধাভোগী আছেন, যারা ৬০০ টাকা করে নগদ মাসিক বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে ‘বাড়তি’ ৯৯ হাজারকে এর আওতায় আনা হচ্ছে। ফলে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬১ লাখ। ভাতা বেড়ে হচ্ছে ৬৫০ টাকা। অর্থাৎ এই কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীরা বাড়তি ৫০ টাকা করে ভাতা পাবেন।
অন্যদিকে বর্তমানে বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জন। নতুন বাজেটে এর সঙ্গে আরও ১ লাখ ২৫ হাজার যুক্ত হবেন। ফলে মোট বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৯ লাখ। বর্তমানে মাসিক বিধবা ভাতা ৫৫০ টাকা। এই ভাতা ১০০ টাকা বেড়ে ৬৫০ টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে।
বর্তমান বাস্তবতায় সামাজিক ভাতার পরিমাণ খুবই কম। বহু বছর ধরে এই ভাতা আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদসহ অংশীজনরা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলেছে, আমরা ভাতার অঙ্ক আরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের সম্পদ সীমিত। চাহিদা অনুযায়ী ভাতা বাড়ানো সম্ভব নয়। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে- যোগ্য আরও বেশি সুবিধাভোগীকে ভাতার আওতায় আনা। আমরা সেটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। প্রতিবছর আওতা বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় এনে এবার আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভাতাও বাড়ানো হচ্ছে।
শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সে তুলনায় ভাতার অঙ্ক খুবই নগণ্য। ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হলে এই খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। জানা গেছে, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে আট ধরনের ভাতা চালু রয়েছে তার জন্য চলতি বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি চালু রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ভাতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক টানাপোড়েন রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমার পরামর্শ হলো; যাদের পাওয়ার যোগ্যতা নেই, তাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভাতাভোগীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। তা হলে যোগ্যরা ভাতা পাবেন এবং ভাতার পরিমাণও বাড়ানো সম্ভব।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের এ-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সামাজিক ভাতা পাচ্ছেন এমন ৪৩ শতাংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, তথ্য সংরক্ষণে এখন ডেটা ব্যাংক করা হয়েছে। ফলে অনিয়মের সুযোগ কম। ভাতা বিতরণেও স্বচ্ছতা এসেছে। মোবাইল ব্যাকিং সেবার মাধ্যমে ভাতার টাকা সরাসরি সুবিধাভোগীর অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বয়স্ক-বিধবা ভাতাসহ এখন ১ কোটি ২৩ লাখ ৪৫ হাজার সুবিধাভোগী বিভিন্ন ধরনের মাসিক নগদ সামাজিক ভাতা পাচ্ছেন। আসন্ন বাজেটে আরও ১০ থেকে ১২ লাখকে নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্বরা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বা তদূর্ধ্ব হলে ভাতা পান। এখন ২৬২ উপজেলায় বয়স্ক ও বিধবা ভাতা চালু রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, সব উপজেলার ভাতাযোগ্য সবাইকে এসব কর্মসূচির আওতায় আনতে হলে আরও আট লাখকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সূত্র বলেছে, বাকিদের পর্যায়ক্রমে আওতায় নিয়ে আসা হবে।
আগামী বাজেটে প্রতিবন্ধীদের আরও সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৩২ লাখ ৩৪ হাজার প্রতিবন্ধী ৮৫০ টাকা করে নিয়মিত মাসিক ভাতা পান। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন ২ লাখ ১৬ হাজার। ফলে মোট ৩৪ লাখ ৫০ হাজার প্রতিবন্ধী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আসছেন। ভাতা ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০০ টাকায় উন্নীত হচ্ছে।
‘দরিদ্র মা ও শিশুদের সহায়তা’ কর্মসূচির আওতাও বাড়ছে। এ কর্মসূচির আওতায় এখন আছেন ১৬ লাখ ৫০ হাজার। নতুন করে আরও যুক্ত হচ্ছেন ১ লাখ ২১ হাজার। ভাতা বাড়ছে ৮০০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা।
তবে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তির সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। সারা দেশে ৮১ হাজার জনকে এই ভাতা দেয় সরকার। চারটি স্তরে ভাতা দেওয়া হয়। প্রাথমিক স্তরে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিকে ৯৫০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিকে ১ হাজার ৫০ টাকা এবং উচ্চতর শিক্ষায় ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকছে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বর্তমানে আট ধরনের কর্মসূচি রয়েছে, যার মাধ্যমে নিয়মিত মাসিক নগদ ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। বর্তমানে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় বছরে দুবার ১৫ টাকা দামে দুস্থদের মাঝে চাল বিক্রি করা হয়। এই কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা হচ্ছে ৫০ লাখ। আগামী বাজেটে আওতা বাড়িয়ে ৫৫ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। অর্থাৎ আওতা বাড়ছে পাঁচ লাখ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ১১ হাজার বেদে ৫০০ টাকা করে ভাতা পান। আগামী বাজেটে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে আরও এক হাজার। এখন ভাতা পান ৫৫০ টাকা। এদের ভাতা বাড়ছে ৬৫০ টাকা। বর্তমানে ১২ হাজার ৬২৯ জন হিজড়া ৬০০ টাকা করে ভাতা পান। নতুন বাজেটে এই ভাতা বেড়ে হচ্ছে ৬৫০ টাকা।
এখন ৬০ হাজার চা-শ্রমিক এককালীন ৫ হাজার টাকা পান। নতুন বাজেটে এই সংখ্যা ১ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। পাশাপাশি এককালীনের পরিবর্তে মাসিক ৬৫০ টাকা ভাতা দেওয়ার নিয়ম চালু হচ্ছে। এ ছাড়া ৬০ হাজার গরিব ক্যানসার রোগীরা আগের মতোই এককালীন ৫০ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা পাবেন।
সামাজিক ভাতার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও মাসিক ভাতা দেয় সরকার। বর্তমানে তারা ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পান। প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা এই সুবিধা পাচ্ছেন। এদের ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, মাসিক ভাতার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ-দুর্যোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ৩০টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন।
পেনশন সুবিধাকেও একধরনের সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এটি নিয়ে প্রশ্নও আছে। বর্তমানে ১১ লাখ সরকারি চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পান। আবার রেশনব্যবস্থা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, জেনারেল রিলিফ, শিক্ষাবৃত্তি, কম দামে গরিবকে চাল বিতরণ, ভিজিডি, ভিজিএফ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে টার্গেট গ্রুপকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় মোট ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। (২০২৩-২৪) বাজেটে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির আড়াই শতাংশ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করে। তখন ভাতা ছিল ১০০ টাকা। পরে ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়। অর্থনীতিবিদরা বলেন, অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতেই হবে। এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি অন্তত ৩-৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম। এশিয়ার ২৫টি দেশের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ‘দ্য সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন্ডিকেটর ফর এশিয়া: অ্যাসেসিং প্রোগ্রেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গত বছর এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি সুরক্ষা পান। আবার সামাজিক সুরক্ষার জন্য গরিব মানুষের পেছনে যতটা খরচ হয়, এর চার গুণ বেশি খরচ হয় ধনীদের পেছনে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রকৃত ভাতাভোগীদের শনাক্ত করতে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ‘ডায়নামিক সোশ্যাল রেজিস্ট্রি’ নামে এ প্রকল্পে ২০ কোটি ডলার সহায়তা করবে বিশ্বব্যাংক। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হবে, যেখানে সব ভাতাভোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হবে। পাঁচ বছরব্যাপী এ প্রকল্পের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যারা ভাতা পাওয়ার যোগ্য তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে।
Sharing is caring!