প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৬শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৪, ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ণ
সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। কিন্তু কী কারণে, আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।’

সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টাওই দিন সেনাপ্রধান আরো বলেন, ‘আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফরমে। অবকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স। নেভি, এয়ারফোর্স উই অল। আমাদের সাহায্য করেন, আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। আমাদের প্রতি আক্রমণ করবেন না।

উপদেশ দেন, আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’

সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টাকিন্তু সেনাপ্রধানের সেই অনুরোধেও ঐক্য বিনষ্টকারীদের অপচেষ্টা থামেনি। কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বেশ কিছু দিন ধরেই সেনাপ্রধান সম্পর্কে কটূক্তি ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বিস্ময়করভাবে নিজের ফেসবুক পোস্টে ‘ক্যান্টনমেন্টের চাপ’-এর কথা বলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন। তবে হাসনাতের এই বক্তব্য তাঁর দলের অনেকেই সমর্থন করতে পারেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীবিরোধী আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেশে বিভাজন তৈরি করতে পারে এবং কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করতে পারে। দেশ এখন একটি কঠিন ও জটিল সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত ঘটনা।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে ফেলতে চাচ্ছে। বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে। একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে জনগণকে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে জনগণকেও সরকারের মুখোমুখি করাতে চাচ্ছে। ত্রিমুখী একটি সংঘর্ষ লাগানোর অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। অস্থিতিশীল করার এই পরিকল্পনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে এবং সর্বোপরি সাহায্য করছে কি না বলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

তাঁরা বলছেন, ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলকারী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেছিল দেশ ও জাতিকে। এই সত্য অনস্বীকার্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৬ অক্টোবর সেনা সদরে নির্বাচনী পর্ষদ ২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই সত্য স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক ভূমিকার কথা স্মরণ করতে অনেকেই ৩ আগস্টের কথা স্মরণ করেন। সেনাবাহিনী আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাবে না, জনগণের পাশে থাকবে—এই বার্তা ৩ আগস্টই ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা সদরের হেলমেট অডিটরিয়ামে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেশের চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে। যেকোনো উসকানির মুখেও ছাত্র ও সাধারণ জনগণের দিকে গুলি না ছুড়তে তিনি সেনা সদস্যদের নির্দেশ দেন। জানা যায়, ওই দিন সেনাপ্রধান তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের কাছে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চান এবং স্পষ্ট করে বলেন, ‘এখন থেকে আর কোনো গুলি নয়।’

সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয়—এ পরিচয়েও জেনারেল ওয়াকারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কারো সঙ্গে আত্মীয়র পরিচয়ের বাইরেও একজন দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে অনেকের মূল্যায়ন। সেনাবাহিনীর ১৩ লং কোর্সে সেনাপ্রধানের কোর্সমেট ছিলেন মেজর জাবের (অব.)। তিনি বলেছিলেন, ‘জেনারেল ওয়াকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার আদেশ মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে আমরা যেভাবে জানি, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সমর্থন দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। আমাদের জানা মতে, ১৭ জুলাইয়ের পর থেকেই এ আদেশ নিয়ে তিনি চাপের মুখে ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।’

শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বনকারী হিসেবে পরিচিত সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল সাইফুল আলম (৫ আগস্টের পর চাকরিচ্যুত) ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। তাতে জানা যায়, ডিজিএফআইয়ের দায়িত্ব ছাড়া আগে জুলাইয়ের শেষদিকে সাইফুল আলম কাউকে এই মর্মে বলছেন যে শেখ পরিবারে জেনারেল ওয়াকার বিয়ে করলেও তাঁর মানসিকতা ভিন্ন। জামায়াত-শিবিরকে তিনি এই যুক্তিতে ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষে যে এখন যাঁরা জামায়াত-শিবির করেন, তাঁদের অনেকের জন্ম একাত্তরের পরে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিল্প-কারখানাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ৮ আগস্ট ঢাকায় সেনা সদরে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ সময় তাঁরা শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা চান। জবাবে দেশের সব নাগরিকের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেন সেনাপ্র্রধান। বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সাপ্লাই চেইন ও বন্দরের নিরাপত্তা এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নির্বিঘ্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী সর্বদা তৎপর আছে।’

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা, পুলিশ সদস্যদের ‘ভগ্ন মনোবল’ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালানো, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, মাদকবিরোধী অভিযান—এসব কাজেও সেনাবাহিনীর নিরলস চেষ্টা অব্যাহত।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে আগের ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ওই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অন্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ছিল।

 

সামরিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার সম্পর্কে সামরিক বিশেষজ্ঞ রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) আব্দুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য সময় এখন খুবই স্পর্শকাতর। ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা খুব সরব। দক্ষতার সঙ্গে তারা পরিস্থিতি পাল্টে ফেলতে চাচ্ছে। বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তারা কিন্তু গত ১৬ বছর বসে ছিল না। অর্থবিত্ত চুরি-ডাকাতি করেছে, দেশের সম্পদ পাচার করেছে। কিছু লোক বাইরে চলে গেছে; আর যারা দেশে আছে, তারা সম্মিলিতভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। জনগণকেও সরকারের মুখোমুখি করাতে চাচ্ছে। ত্রিমুখী একটি সংঘর্ষ লাগানোর অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। এই অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে এবং সর্বোপরি সাহায্য করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেনাবাহিনী হচ্ছে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকে থাকবে না। সেই সময় আমাদের প্রতিবেশী দেশ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিই চাচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা। শুধু ফ্যাসিস্ট না, ফ্যাসিস্টের চেয়ে যদি কঠিন শব্দ থাকে সে শব্দ হাসিনা ও তার দোসরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। শুধু অর্থ লুটপাট না, এ দেশের মানুষের চরিত্রও ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে ওরা। এই চরিত্র ধ্বংস শুধু নিজেদের দলের মধ্যে না, প্রশাসনের চরিত্র ধ্বংস করেছে, পুলিশের চরিত্র ধ্বংস করেছে, রাষ্ট্রের যত স্টেক হোল্ডার রয়েছে, সবার চরিত্র ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। তারা জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারাই এখন চাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি নানাভাবে অস্থিতিশীল করতে। এ জন্য দুর্বল লোকজন খুঁজে বের করছে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ম্যাচুরিটি লাগে। বুঝতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতে নাড়া দিতে হয় না। এতে নিজেদেরই ক্ষতি হয়। পরিকক্বতার অভাবে তাদের দলকে দুর্বল ভাববে মানুষ। দলটার প্রতি সাধারণ মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছিল; কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনীর প্রতি রুখে দাঁড়ানোর হুমকি, দেশকে টালমাটাল করার চেষ্টা যারা করে, তাদের প্রতি তো মানুষ আস্থা রাখতে পারবে না। তারা ভুল করেছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি সামরিক ও সামাজিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলব, এখনো যদি পরিস্থিতির অবনতি হয়, মানুষ আর্মির কাছে চলে যাবে। এখন যদি আর্মি উঠিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে আপনারা কল্পনা করতে পারছেন? রাস্তায় হাঁটার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। এই বিষয়টি অনেকে বোঝেন না। যদি গণ্ডগোল লাগে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই বলবেন, আর্মি নামাও। তখন বাধ্য হয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা এই পরিস্থিতিই সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। সামরিকবাহিনী সম্পর্কে ঘরোয়াভাবে যে কথা বলা যায়, প্রকাশ্যে তা বলা উচিত না। সেনাবাহিনী প্রধান একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর মর্যাদার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মর্যাদাও জড়িত। কেউ যদি ঘরোয়া আলোচনায় কিছু বলে থাকেন, সেটা প্রকাশ করা ঠিক না। কেউ কি তাদের ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করেন? কোনো ব্যক্তির নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। সেই মতামত তো বাইরে প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। উনি তো কাউকে ডেকে নিয়ে যাননি। যাঁরা এই অপরিপক্ব কাজটি করেছেন, তাঁরাই এখন বলছেন, আমাদের ভুল হয়ে গেছে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পক্ষে একাত্ম থাকে। ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বা জুলাই বিপ্লবের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তী সাত মাসে পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের শক্তিশালী কার্যকর শক্তি হলো সেনাবাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত ঘটনা। আমরা জটিল ও কঠিন সময় পার করছি। এই সময় জুলাই বিপ্লবের অসাধারণ সাহসী ও বীরত্বসুলভ ভূমিকা পালনকারী কিছু তরুণ নেতার (বর্তমানে এনসিপি নেতা) সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীবিরোধী আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেশে বিভাজন তৈরি করতে পারে এবং কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করতে পারে। এখন সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতা কাম্য। এই ক্রান্তিলগ্নে প্রয়োজন ঐক্যের।’

মেজর জেনারেল ( অব.) মো. নাঈম আশফাকুর চৌধুরী বলেন, “আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের একটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ইন্টিগ্রেশন। আমাদের অবজেক্টিভ হওয়া দরকার ঐক্য। ভিন্নমত থাকতেই পারে। একেকজনের একেক ধরনের মতামত হবে—এটাই বিউটি অব ডেমোক্রেসি। কিন্তু দেশের ইউনিটিকে ধ্বংস করা কারোরই উচিত না। বিশেষ করে যাঁরা কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। তিনি স্টুডেন্ড লিডার অথবা পলিটিক্যাল লিডার হলে তাঁর প্রতিটি বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণ তাঁর প্রতিটি শব্দ তাঁর অনুপস্থিতে ইন্টারপ্রিটেশন করবে এবং নিজেদের মতো করে বুঝে নেবে। এই জন্য তিনি কী বাক্য, শব্দ ব্যবহার করবেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, কী কী ভাবে হতে পারে এসব দিক বিবেচনা করে মন্তব্য করা উচিত। বিশেষ করে পোস্ট জুলাই রেভল্যুশনের পরের যে অবস্থা, আমরা একটি জটিল সময় পার করছি, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সব সংস্কার তো আর এত দ্রুত করা যাবে না। রাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে সেগুলোর সংস্কার দরকার। নির্বাচনও এগিয়ে আসছে। এই সময় সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক এবং ঐক্যবিনষ্টকারী বক্তব্য অপ্রত্যাশিত। কারো প্ররোচনায় এ ধরনের বক্তব্য এসেছে কি না সেটাও জানার বিষয়। আমার মতে, আমাদের ঐক্যের দিকেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। অনৈক্যের দিকে নয়। ‘আমি’ ও ‘আপনি’ এই সব শব্দ বাদ রেখে এখন ‘আমরা’ বলতে হবে। ‘আমরা’ কখন, কিভাবে বলতে পারব তার ওপর কাজ করা উচিত। যা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত। সেনাবাহিনীকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য সাধারণ জনগণও মেনে নিচ্ছে না। আপনি একদিকে বলবেন সেনাবাহিনীই হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য শেষ ভরসা, আবার এই সংস্থার দিকে আঙুল তুলছেন। এটা শুধু সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তোলা নয়, রাষ্ট্রের দিকেও আঙুল তুলছেন।”

এনসিপি নেতার ভুল স্বীকার : সেনাবাহিনীকে নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহর কথাগুলো যেভাবে ফেসবুক স্ট্যাটাসে এসেছে, সেই প্রক্রিয়াটি সমীচীন মনে হয়নি। এর ফলে পরবর্তী সময়ে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দলটির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে—এ মন্তব্য করেছেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথিত বৈঠকের ১০ দিন পর হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ২১ মার্চ তাঁর ফেসবুকে সেনাপ্রধান, সেনাবাহিনী সম্পর্কে আক্রমণাত্মক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর নিজ দলের মধ্যেই ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটে। হাসনাত আব্দুল্লাহ ওই পোস্ট সম্পর্কে গতকাল রবিবার নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আরেক মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি ‘১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে আমার জায়গা থেকে কিছু সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন’ শিরোনামে লেখেন, ‘সেদিন আমি এবং হাসনাত সেনাপ্রধানের সাথে গিয়ে কথা বলি। আমাদের সাথে আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন সদস্যেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারেননি। প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখি, সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজরের সাথে যখন প্রয়োজন হতো তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো। যেদিন সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে (২৫ ফেব্রুয়ারি) অনেকটা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’ তখন আমি সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজরকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদের দৃষ্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখছেন কি না? সেনাপ্রধানের বক্তব্য তুলনামূলক ংঃত্ধরমযঃ-ভড়িধত্ফ এবং যধত্ংয মনে হচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমরা কি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাও? আমি বললাম, বলা যেতে পারে। এর পর সেদিন সেনাপ্রধানের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। সেনাভবনে সেই রুমে আমরা তিনজনই ছিলাম। সেনাপ্রধান, হাসনাত এবং আমি। মানুষ হিসেবে যেকোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে আমার সে ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে। আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি ‘প্রস্তাব’ দেওয়ার আঙ্গিকে দেখি না; বরং ‘সরাসরি অভিমত প্রকাশের’ মতো করে দেখি। ‘অভিমত প্রকাশ’ এবং ‘প্রস্তাব দেওয়া’ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও পূর্বের তুলনায় সেদিন সেনাপ্রধান অনেকটা স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড ভাষায় কথা বলছিলেন। পাশাপাশি ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের জন্য ‘চাপ দেওয়ার’ যে বিষয়টি এসেছে সেখানে ‘চাপ দেওয়া হয়েছে’ এমনটি আমার মনে হয়নি; বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।’

Sharing is caring!