প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৬শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঈদ বাণিজ্য

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৩, ২০২৫, ০৫:২৮ অপরাহ্ণ
নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঈদ বাণিজ্য

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে দেশে বাণিজ্য হয় কমবেশি পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার। গত কয়েক বছরে দোকান মালিক সমিতির হিসাব বলছে এমনই। এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় এবার কমবে। তবে বেচাকেনা একেবারে খুব কম হবে এমনটিও নয়।

এবার ঈদের বেচাকেনা কেমন- এ প্রশ্নের জবাব একেক ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে একেক রকম। কেউ বলছেন ভালো, কেউ বলছেন খুব খারাপ। কেউ আবার জমজমাট বেচাকেনা করেছেন, কেউ আছেন শেষ মুহূর্তে ভালো কিছুর অপেক্ষায়।

১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া সবশেষ তথ্য বলছে, ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি বেড়েছে। চলতি (মার্চ) মাসের ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার বেশি।

এই ১৯ দিনের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১২ কোটি ডলার বা এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মার্চে প্রবাসী আয়ে নতুন রেডর্ক সৃষ্টি হতে পারে।

ঈদ কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া বইছে। বিগত কয়েক মাসের চেয়ে এখন অর্থ প্রবাহ অনেক বেশি। এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ঈদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে অনেকটা সহায়ক হবে। তবে ঈদকেন্দ্রিক অনেক ব্যয় এবার সংকোচন হবে বেশ কিছু কারণে। যার প্রভাব পড়তে পারে ঈদের টোটাল বাণিজ্যে।

 

ঈদের এ অর্থনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে এখন খুব স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি নেই। আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তে আছি, যে কারণে নিত্যদিনের ব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর। ফলে অন্য বছরের তুলনায় ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় কম হবে, সেটা অনুমান করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আয় বাড়েনি। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে পোশাক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে। যে কারণে মানুষ ব্যয় সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছে।’

 

এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। এবছর ঈদে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়া কমবে। গাড়ি-দামি আসবাবপত্র কেনার মতো ব্যয়, যা আগের ঈদগুলোতে লক্ষ্য করা যেত, সেটা হয়তো কম হবে।’

 

 

এরপরও কেনাবেচা যে থেমে রয়েছে তা কিন্তু নয়। ঈদ যত কাছে আসছে, দোকানপাট ও বিপণি-বিতানগুলোতে ভিড় বাড়ছে। পোশাক, জুতা, ইলেকট্রনিক পণ্য, এমনকি ঈদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। আবার অনলাইনে ব্যবসা (ই-বিজনেস) বেড়েছে, দেশে-বিদেশে ভ্রমণেও যাচ্ছেন অনেকে।

 

ঈদ-অর্থনীতি কত বড়

ঈদে অর্থের প্রবাহ কেমন থাকে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। কিছু অনুমান করার মতো সমীক্ষা থাকলেও তা পুরোনো। তবে ঈদের অর্থনীতির আকার যাই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। কারণ ঈদ ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির বড় অংশজুড়েই পোশাকের রাজত্ব। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির করা একটি জরিপে দেখা যায়, ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ব্যবসা হয় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক খাতে খরচ হয় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নামাজের টুপি থেকে শুরু করে দুধ, চিনি ও আনুষঙ্গিক প্রায় সবকিছুর পেছনেও অনেক টাকা খরচ হয়।

 

ঈদের সময় সেমাই, চিনি, সুগন্ধি চালসহ এমন নানা পণ্যের পেছনে মানুষ খরচ করে। ফিতরা, জাকাত, দান-খয়রাত, উপহার দিতে প্রচুর ব্যয় হয়। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ কোটি মানুষ যাতায়াত করে। পরিবহন খাত সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় এ সময়।

 

সাধারণত ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স আসা তুলনামূলক বাড়ে। সবকিছু ঈদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়তা করে।

 

কেমন যাচ্ছে এবারের বেচাকেনা

ঈদ ও পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করেই মূলত দেশে গড়ে উঠেছে ফ্যাশন হাউজকেন্দ্রিক দেশীয় পোশাকশিল্প। দেশে পাঁচ হাজারের বেশি ফ্যাশন হাউজ আছে। এর বেশির ভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ফ্যাশন হাউজগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ফ্যাশন হাউজগুলোতে বছরে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকার পোশাক বেচাকেনা হয়। সারা বছর তাদের যে ব্যবসা হয়, তার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে।

এসব বিষয়ে ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠনটির পরিচালক এবং রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস বলেন, ‘অন্য বছরের মতো এবছরও প্রতিটি পোশাক ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিয়েছেন ঈদের জন্য। এবছর ভারতের বাজার বন্ধ থাকায়, অর্থাৎ কেনাকাটার জন্য ভারত যেতে না পারায় বড় ক্রেতারা দেশের মার্কেটে আছেন।’

 

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রি বাড়ছে। এবারও বিক্রি হচ্ছে। যদিও শুরুতে বেচাবিক্রি কম হলেও ১৫ রোজার পর থেকে বিক্রি অনেক বেড়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবছর বেচাকেনা অন্য বছরের মতোই হবে।’

 

ফরচুনের প্রিয় শাড়ি গ্যালারির এনামুল হক বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়েছে। পোশাকের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। আবার দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবার ঈদের বাজারেও প্রভাব ফেলছে। যে কারণে বিক্রি কমেছে।’

 

কেক্র্যাফটের জামিউল হক বলেন, ‘আগে যেমন এক শ্রেণির মানুষ হাত খুলে খরচ করেছে, তারা এখন নেই। এখন আবার নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। কাস্টমারের বেজ চেঞ্জ হচ্ছে। যে কারণে বিক্রি মিশ্র মনে হচ্ছে।’

নিউ স্বর্ণদ্বীপ জুয়েলার্সের নয়ন হোসেন বলেন, ‘মানুষ সংসারের সব খরচ মিটিয়ে তারপর সোনা কেনে। একদিকে মানুষের হাতে সেই টাকা নেই, অন্যদিকে সোনার দাম বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে বিক্রি খুব কম।’

মৌচাকের আয়েশা কমপ্লেক্সে তুলি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এ ঈদে (ঈদুল ফিতর) পাঞ্জাবির কাটতি খুব ভালো থাকে। সময় যত এগোচ্ছে, ক্রেতার চাপ তত বাড়ছে। কেনাবেচা ভালো।’

জুম কসমেটিকসের বিক্রেতা চন্দন হক বলেন, ‘রোজার শেষ অংশে প্রতিদিন আগে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। সেখানে এখন ৮-১০ হাজার টাকার বিক্রি করতে পারছি না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ।’

সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট, শাড়ি-লুঙ্গির কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের সম্ভার ইসলামপুর এখন দেশের বৃহত্তম কাপড়ের বাজার। ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নিবন্ধিত ছোট-বড় দোকানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এর বাইরে আছে আরও দুই হাজার ছোট-মাঝারি দোকান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইসলামপুরে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ কোটি টাকার কাপড়ের ব্যবসা হয়। ঈদের আগে কখনো কখনো তা শতকোটি টাকায়ও গিয়ে ঠেকে। এবছরও ঈদের শেষ মুহূর্তে বিক্রি বাড়বে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।
বেচাকেনা বাড়ে আরও বহু পণ্যের

দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ২০ কোটি জোড়া পাদুকা বিক্রি হয়। পাদুকার স্থানীয় বাজার বছরে আনুমানিক ছয় হাজার কোটি টাকার। সারা বছর যত পাদুকা বিক্রি হয়, তার ৩০ শতাংশ বিক্রি হয় ঈদুল ফিতরে। সে হিসাবে, আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার পাদুকা বা জুতা বিক্রি হয় ঈদে।

এছাড়া প্রসাধনী ও গহনা বিক্রি বাড়ে ঈদে। বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘রোজার ঈদের পর কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অনেক বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান হয়। এর কার্যাদেশ রমজান মাসেই পান ব্যবসায়ীরা। ফলে এসময় সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হয়।’

 

এছাড়া দেশে বর্তমানে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি ঈদকেন্দ্রিক আয়-ব্যয় হয়।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ঈদ এমন উৎসবে পরিণত হয়েছে যে, সবক্ষেত্রেই লেনদেন বাড়ে। কাপড়, জুতা, কসমেটিকস ছাড়াও মুদি দোকানের বিক্রি বাড়ে। যেমন মিষ্টি-দই সবই বিক্রি ভালো হয়। ডিজিটাল লেনদেন, দর্জি সবখানেই একটি হাওয়া লাগে। আশা করছি এবারও অন্য বছরের মতো ভালো ব্যবসা হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন সবাই ঈদ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করতে চান। অন্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। এখন উপহার দেওয়ার রীতিতেও অনেক কেনাবেচা হয়।’

ঈদ সামনে রেখে লোকজন এখন গাড়িও কেনেন। এর সংখ্যাও কম নয়। বছরে যত গাড়ি বিক্রি হয় এর প্রায় ২০ শতাংশ ঈদে হয় বলে জানায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক ও বিক্রেতাদের সংগঠন বারভিডা।

 

ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে

ঈদ কেন্দ্র করে সেমাই, চিনি, দুধসহ অন্য বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এমনকি শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ঈদকেন্দ্রিক সেমাই রপ্তানিও বাড়ে। এছাড়া সেমাই প্রস্তুতকারক বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঈদুল ফিতরে দেশে আনুমানিক ৮০ লাখ কেজি সেমাইয়ের চাহিদা থাকে। দেশের বাইরে রপ্তানিও হয় উল্লেযোগ্য পরিমাণে।

জানা যায়, আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ঈদকেন্দ্রিক সেমাই রপ্তানি করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। রপ্তানি দেশের সংখ্যা এখন ৪০টি।

ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ বলেন, ‘বিদেশেও সেমাইয়ের একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। সারা বছর যে পরিমাণে সেমাই রপ্তানি হয়, এর ৭০ শতাংশ ঈদকেন্দ্রিক। ওইসব দেশেও এখন উৎসব ও অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক পণ্য বাংলাদেশি সেমাই।’

এদিকে চিনি, তেলসহ অন্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। দেশের অন্যতম বৃহৎ পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের বিক্রি বেড়ে যায়। এখন মানুষ আপ্যায়নে বেশ খরচ করে।’

Sharing is caring!