
প্রজন্ম ডেস্ক:
একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনায় একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে মাঠ প্রশাসনে। সিভিল প্রশাসনের সর্বস্তরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনও ভায়োলেন্স ঘটার আশঙ্কায় স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোথাও মিলেমিশে, আবার কোথাওবা বুঝিয়ে-শুনিয়ে আপাতত দৈনন্দিন কার্যক্রম সামাল দিচ্ছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যেই নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। তবে মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ফুটপাতের সামান্য একটি দোকানও তারা উচ্ছেদ করার সাহস পাচ্ছেন না। কারণ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্টরা লোকজন জড়ো করে মব তৈরির চেষ্টা করেন।
প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা এখনো অনুপস্থিত। পুলিশের মনোবলও এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি বলে পুলিশের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও একাধিকার স্বীকার করেছেন।
আওয়ামী লীগের বিরোধী বলে পরিচিত (যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন) দলগুলোর বেশির ভাগ নেতাই এখন বেশ বেপরোয়া। তাদের কথাবার্তা ও আচরণে এমন একটা ভাব স্পষ্ট যে প্রশাসন তাদের কথার বাইরে কিছুই করতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন বলে আলোচনা আছে। এদের অনেকেই সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের কথা শুনতে চাইছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা উল্টো প্রশাসনের লোকদের শাসাচ্ছেন। পুলিশ বা প্রশাসনের তরফ থেকে বলতে গেলে তাদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ অভিহিত করে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তাদের চলতে হচ্ছে।
তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সুবিধাভোগী সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে মাঠ প্রশাসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ওএসডি করাসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। এতে মাঠ প্রশাসন এবং সচিবালয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা বিরাজ করছে। যেকোনো ঘটনার সূত্র ধরে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে যে কারও ভাগ্য ঝুলে যেতে পারে, এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে তাদের।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাত মাসে সারা দেশে মব ভায়োলেন্সসহ অন্যান্য গণপিটুনিতে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সব মিলিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রশাসনে মোট ওএসডি আছেন ৫১৬ জন। এ ছাড়া দুজন গ্রেড-১ কর্মকর্তা, ৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ৭৬ জন যুগ্ম সচিব, ১৩৬ জন উপসচিব, ১৫৫ জন সিনিয়র সহকারী সচিব, ৯৪ জন সহকারী সচিব এবং ৮ জন সিনিয়র সহকারী প্রধানকে ওএসডি করা হয়েছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রাথমিকভাবে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এমন ৩৩ জন কর্মকর্তাকে গত ১৯ জানুয়ারি ওএসডি করা হয়েছে। একই কারণে এর আগে ১২ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়।
মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে পুলিশের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তা ছাড়া মব জাস্টিস প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের তাড়ানোর নামে অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদেরও হয়রানিসহ কথায় কথায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, ঝাড়ু মিছিল, ঘেরাও, এমনকি প্রশাসনের ওপর হামলার ঘটনাও ইতোমধ্যে ঘটেছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জেলার ডিসির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে অধিকাংশই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ জেলার একজন ডিসি নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। সমঝোতা করেই প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। সকালে অফিসে আসি একটা আতঙ্ক নিয়ে। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ভয় কাজ করে, এই বুঝি কোথাও মব তৈরি হয়ে গেল। আবার কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সব সময় এই আতঙ্ক থাকে মনে।’
তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো সমস্যা আমরা দেখছি না। সমস্যা মাঠপর্যায়ে। মাঠপর্যায়ে এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে জনগণের মধ্যে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। প্রত্যেকেই মনে করে স্বাধীন। তার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। তারা নিজেদের মতো আইনশৃঙ্খলা বিচার-বিশ্লেষণ করে আইনকে হাতে নিয়ে নেয়। মনমতো না হলেই সে নিজের মতো করে প্রতিরোধ করতে চায়। এমন বিষয়গুলো আমরা এখন লক্ষ করছি। আরেকটা বিষয়, তা হলো আগে পুলিশ বা অন্য বাহিনী কিন্তু এখনো নিজেদের সক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন নেতাকেও কোনো অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার বা নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাও ভয় পাচ্ছেন। এখন সামনে নির্বাচনের মতো একটা বড় বিষয় আছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন জটিল অথচ বৃহৎ একটি কর্মযজ্ঞ কীভাবে হবে, তা বোধগম্য না।’
তিনি বলেন, ‘তৃতীয়ত; কথায় কথায় একটা মব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারলে বড় কোনো দুর্ঘটনা যে ঘটে যেতে পারে। এটা যে কেউ যখন-তখন তৈরি করতে পারে। ছাত্ররা পারে, শ্রমিকরা পারে অথবা যেকোনো পেশার যেকোনো গোষ্ঠী, যখন-তখন একটা মব তৈরি করে ফেলতে পারে। আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে একটা আদেশ দিলেও এর বিরুদ্ধে জড় হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিয়ে ফেলে তারা।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একটা পার্কে অবৈধ দোকান বসতে দেব না বা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করতে দেব না বা বাজারে অথবা ফুটপাতে অনুমোদনহীন দোকানপাট বসতে দেব না। এমন পদক্ষেপ নিতে গেলে দেখা যাবে দোকানিরা বা পরিবহন শ্রমিকরা জোট বেঁধে একটা মব তৈরি করে ফেলল। এভাবেই তারা আইনটাকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া বা আইন না মানার প্রবণতা, মব তৈরি করার প্রবণতা- এই বিষয়গুলো আমরা সাংঘাতিকভাবে দেখছি। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা-কর্মী আছেন (নির্দিষ্ট কোনো দলের কথা নয়), তারা অনেকটা বল্গাহীন হয়ে গেছেন। তাদের ওপরে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে, না তাদের নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের আছে। এই নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যে কেউ যেমন তেমন করে তাদের ইচ্ছামতো কার্যক্রম করছে। আসলে তারা এখন আর প্রশাসনকে একবারেই ভয় পাচ্ছে না। আগে ডিসিরা একটু উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতেন। এখন তেমন হলেই ডিসির সঙ্গেই উদ্ধত ব্যবহার করা হয়। ডিসি জোরে কথা বললেও মানুষ এখন নেগেটিভলি দেখছে। এই বিষয়গুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নরম হয়ে বাবা-সোনা বলে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আমাদের ম্যানেজ করতে হচ্ছে। আসলে এই মুহূর্তে ফোর্স ব্যবহার করে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগই আমরা দেখছি না। যতটুকু সম্ভব ভালো সম্পর্ক রেখে যেভাবে ম্যানেজ করা যায়, এখন সেটাই আমরা করছি। অন্যথায় যেকোনো সময় জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন একটা বিশ্বাস-আস্থা দিয়ে এখন আমরা প্রশাসনকে চালিয়ে নিচ্ছি। কারণ ফোর্স অ্যাপ্লাই করার এক শতাংশও সুয়োগ নেই মাঠ প্রশাসনের।’
অপর এক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও পরে বলেন, ‘আমাদের এখন আইনের ভেতরে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য ফোর্স সহযোগিতা করছে। প্রশাসন মানুষকে বোঝোচ্ছে।
দীর্ঘদিনের একটা অপচেষ্টা, অপসংস্কৃতির যে প্র্যাকটিস তা তো আর রাতারাতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য সময় প্রয়োজন। আমরা আইনের ভেতরেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। জুলাই-আগস্টের পর যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সবাইকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে চলাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা চেষ্টা করছি, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুষ্ঠু একটা পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। যাতে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকতে পারে।’
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাক আহমেদ জানান, একজন জেলা প্রশাসক কী কাজ করবেন তার একটা সীমা-পরিসীমা আছে। একটি জেলার যেকোনো বিশৃঙ্খল বা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করাই জেলা প্রশাসকের কাজ। যেকোনো পরিস্থিতি হোক। এটা ৫ আগস্টের আগের বা পরের কোনো বিষয় না। বরং ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো। কারণ এখন রাজনৈতিক শক্তিমত্তার জায়গাটা অনুপস্থিত। কাজেই অন্য সময় যেসব চ্যালেঞ্জ থাকে, এখন বরং সেসব কম। তাই মাঠ প্রশাসনসহ সব সরকারি দপ্তরই কোনো চাপ ছাড়াই দায়িত্ব পালন করতে পারছে। তাই আমার কাছে কোনো চাপ মনে হয়নি, ভালোভাবেই কাজ করতে পারছি। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো কিছুই প্রশাসন বরদাশত করছে না।’
তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে আইনের শাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। সেটাই আমাদের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য। এখন কেউ যদি নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চায়, সে ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন- এমন নির্দেশনা এই জেলায় দেওয়া হয়েছে। এই জেলার পরিবেশ বেশ শান্ত। এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সবাই মিলেমিশে আছে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মতো কোনো সংকট এখানে হয়নি।’
Sharing is caring!