প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৪ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

‘খানা জরিপ প্রকল্পে’ হরিলুট

editor
প্রকাশিত মার্চ ১৩, ২০২৫, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ণ
‘খানা জরিপ প্রকল্পে’ হরিলুট

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০২১ প্রকল্পে ৮৪ জন তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের এক বছরের কাজ মনিটরিং করতে খরচ হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা অস্বাভাবিক খরচ। কারণ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির আট সেক্টরের কর্মকর্তারা ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প মনিটরিং করতে বছরে টাকা খরচ করেন ৬০ লাখ। আড়াই হাজার বই মুদ্রণে ৮৯ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিসহ (পিআইসি) বিভিন্ন মিটিংয়ে সম্মানীর নামেও ৫৯ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে এই প্রকল্পে। পরীবিক্ষণ ও মূল্য়ায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

আইএমইডির পরিচালক মুহাম্মদ কামাল হোসেন তালুকদার সম্প্রতি এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খানা জরিপের নামে এভাবে বিভিন্ন খাতে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। এটা অবশ্যই দেখতে হবে। কারা, কীভাবে এই অর্থ খরচ করেছেন এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এই প্রকল্পে তথ্য সংগ্রহকারীদের মনিটরিং করতে যেভাবে টাকা খরচ হয়েছে তা খুবই অস্বাভাবিক। এটা পরিষ্কার যে এই প্রকল্পে প্রচুর অপচয় হয়েছে। পিআইসিসহ অন্য কমিটির সদস্যরা যেভাবে সম্মানী নিয়েছেন, তাদের অবদান কী তা দেখা দরকার। বিবিএসের বোঝা উচিত, উন্নয়ন বাজেট থেকে এভাবে অর্থের অপচয় করা ঠিক না। তাদের অর্থ ব্যয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এগুলো জনগণের করের টাকা।’ আইএমইডির সচিব মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো প্রকল্পে অর্থের অপচয় হোক এটা আমরা চাই না। এ প্রকল্পে অপচয় হয়ে থাকলে তাদের (বিবিএস) দেখা দরকার।’

 

এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা সচিব আলেয়া আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। কিছু বলার আগে জানতে হবে। একটু সময় দেন। এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না।’ পরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে  তিনি বলেন, ‘আইএমইডি খানা জরিপের প্রতিবেদন তৈরি করে যে ব্যাখ্যা চেয়েছে, তা তৈরি করা হচ্ছে। খুব দ্রুত জবাব দেওয়া হবে।’

 

ভ্রমণ ব্যয়ের ব্যাপারে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘একটা প্রকল্প অনেক দিন ধরে চলে। তথ্য সংগ্রহকারীদের মনিটরিং করতে হেড অফিস, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। আইএমইডির প্রতিবেদনে খরচের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়নি। অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু প্রতিবেদনের বই প্রিন্ট ও বাঁধাই করার ব্যাপারে এই অর্থ খরচ করা হয়নি। এর সঙ্গে জরিপের কাজে যেসব পেপার ব্যবহার করা হয়েছে তাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকারি বিধিবিধান মেনেই পিআইসিসহ অন্যান্য কমিটির সদস্যদের সম্মানী দেওয়া হয়েছে। সরকারি নিয়ম মেনেই জিনিসপত্র কেনা হয়েছে।’

 

 

সূত্রমতে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিভিন্ন সূচক পরিমাপ করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিবিএস ‘হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০২১ পাইলট’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এটি বাস্তবায়ন করতে খরচ ধরা হয় ১২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২০-এর জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাতে সরকার ২০২০ সালের এপ্রিলে অনুমোদন দেয়। পল্লি ও শহর এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার ৪০০টি খানায় এই জরিপ করার সিদ্ধান্ত হয়।

 

কিন্তু করোনার কারণে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারীরা কাজ করতে না পারায় সেটা সম্ভব হয়নি। এ জন্য এক বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় ও খরচ বাড়িয়ে ১৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সারা দেশে ৮৪ জন তথ্য সংগ্রহকারীর মাধ্যমে এই জরিপ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৬ থেকে ১২ জুন পাইলট জরিপের জন্য এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের মনিটরিং বা দেখভাল করতে সর্বোচ্চ খরচ করা হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৪৫ লাখ টাকা বা মোট খরচের প্রায় ১৯ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রথমে ২০২০-এর ২৯ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত পঞ্চম গ্রেডের (বর্তমানে যুগ্ম সচিব) ড. দিপংকর রায় এবং উপপরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ (৬ষ্ঠ গ্রেড) ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এই অর্থ খরচ করেছেন, যা খুবই বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

কারণ সরকারি বিধি অনুযায়ী চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তারা অফিশিয়াল কাজে ভ্রমণে দৈনিক ভাতা পান ১ হাজার ৫০ টাকা। সঙ্গে নির্ধারিত অর্থাৎ বাস বা বিমানের যাতায়াতের ভাড়া পান। এই প্রকল্পে সারা দেশে এক বছরে ৮৪ জন তথ্য সংগ্রহকারীকে মনিটরিং করতে খরচ করা হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বা মোট খরচের প্রায় ১৯ শতাংশ, যা খুবই বেশি ও অস্বাভাবিক। কারণ মাঠপর্যায়ে মনিটরিং বা পরিদর্শনকালে পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা সরকার-নির্ধারিত হারে ভাতা (টিএ-ডিএ) পাবেন। কোনো কর্মকর্তা ভ্রমণ ব্যয় বাবদ কত টাকা খরচ করেছেন, তা বিবিএস কর্তৃপক্ষকে যাচাই করে দেখার জন্য বলা হয়েছে।

 

 

একইভাবে খানা আয়-ব্যয় জরিপের ৫০০ কপি ড্রাফট ও ২ হাজার কপি চূড়ান্ত প্রতিবেদন (রিপোর্ট) ছাপাতে ও বাঁধাই করতে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা বা মোট খরচের ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এই খরচও সমজাতীয় প্রকল্পের ব্যয়ের সঙ্গে যাচাই করে অনেক বেশি। পিআইসি, স্টিয়ারিং এবং অন্যান্য কমিটির সম্মানী খাতেও অত্যধিক বেশি ৫৯ লাখ টাকা বা মোট খরচের ৫ দশমিক ১২ শতাংশ খরচ করা হয়েছে। এটাও সমজাতীয় প্রকল্পের চেয়ে বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে আউটসোর্সিং, কনসালট্যান্সি, ফার্নিচার প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে ১১ কোটি ৫১ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।

Sharing is caring!