স্টাফ রিপোর্টার:
খাতাপত্রের হিসাব বলছে, গত এক বছরে ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় গাজায় প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে ব্যাপকভাবে অনুমান করা হয়, নিহত ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি।
এই সময়টাতে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী দফায় দফায় পশ্চিম তীরেও হামলা চালিয়ে সেখানকার ৭৪০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
গত মাসে ইসরায়েল লেবাননে তাদের সহিংস আক্রমণ বাড়ায়। সেখানে শুধু ২৩ সেপ্টেম্বরে হামলায় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। দুই সপ্তাহে ইসরায়েল লেবাননের দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার পুরো বসতি এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। তারা বুলডোজার দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে, অবকাঠামো ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বোমা মেরে ধ্বংস করেছে।
আবাসিক ভবনগুলোকে তারা পিষে ফেলেছে। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। পানি সরবরাহ কেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সৌর প্যানেলগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।
এককথায় ইসরায়েল গাজায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।
ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের গাজার বিশাল অংশ থেকে ‘খালি’ করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা গাজার মাত্র ১৬ শতাংশ ভূমিতে ফিলিস্তিনিদের ঠেলতে ঠেলতে এনে জড়ো করেছে।
ঠিক একই কৌশলটি তারা পশ্চিম তীরের কিছু এলাকায়ও অবলম্বন করেছে। এখন লেবাননে সেই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের বলা হচ্ছে, ইসরায়েলের ‘সামরিক অভিযান’ শেষ হলে তারা আবার তাদের ভিটাবাড়িতে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, ঔপনিবেশিকরণের জন্য ভূমি খালি করার উদ্দেশেই এই গণহত্যা চালানো হচ্ছে।
১৯৪৮ সালের নাকবার সময়ও এমন হয়েছিল। জাতিসংঘে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস হওয়ার পরও ফিলিস্তিনিদের কখনোই তাদের বাড়িতে আর ফিরে যেতে দেওয়া হয়নি। এ কারণেই ফিলিস্তিনিরা কখনো তাদের ভিটে ছাড়বে না।
কিছু বাইরের মানুষের পক্ষে ফিলিস্তিনিদের ভূমির প্রতি অবিচল ভালোবাসার বিষয়টি বোঝা কঠিন হতে পারে।
বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা আমাদের বহিষ্কার করে ভেবেছিল আমরা আরব বিশ্বের বাইরে চলে গিয়ে স্রেফ গায়েব হয়ে যাব।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিরা যেখানেই যাক, সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা তাদের ভূমির ন্যায্য দাবিতে অটল আছে। তারা হাল ছাড়েনি।
প্রশ্ন হলো, ক্রমাগত বোমাবর্ষণ, হামলা, বসতি স্থাপনকারীদের দখল এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের মুখেও কেন ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়ি ও পূর্বপুরুষদের ভূমি ছেড়ে যেতে চায় না?
এই প্রশ্নটি ফিলিস্তিনি পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত এবং মৌলিক একটি বিষয়।
এটি শুধু ভৌগোলিক অবস্থান বা সম্পত্তি মালিকানার ব্যাপার নয়। এটি একটি গভীর সংযোগের বিষয়, যা ফিলিস্তিনি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সামষ্টিক স্মৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ফিলিস্তিনের মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকার এ সিদ্ধান্তে একধরনের জেদ রয়েছে। কারণ, তারা মনে করে, নিজের আবাস ছেড়ে যাওয়া মানে এমন একটি সংযোগ ছিন্ন করা, যা কয়েক প্রজন্ম ধরে টিকে আছে।
কৃষিভিত্তিক সমাজ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের সংস্কৃতিতে এবং সামষ্টিক চেতনায় ভূমির একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। জলপাইগাছ এই সংযোগের প্রতীক।
জলপাইগাছের প্রাচীন ইতিহাস আছে। শত প্রতিকূলতায় এই গাছ টিকে থাকতে পারে। এর শিকড় অনেক নিচে গেড়ে যায়। এই গাছের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের গভীর মিল আছে।
এখানকার পরিবারগুলো এই গাছগুলোকে যত্ন করে, যেমন তারা তাদের ঐতিহ্যকে যত্ন করে। জলপাই সংগ্রহ করা, তা থেকে তেল বের করা এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে সেই তেল ভাগ করা তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের মতোই একটি কাজ।
এ কারণেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের জলপাইবাগানগুলো ধ্বংস করে আনন্দ পায়।
তারা জানে, একটি জলপাইগাছ ধ্বংস করলে তা শুধু ফিলিস্তিনিদের জীবিকার ওপর আঘাত হানে না, এটি ফিলিস্তিনি পরিচয়ের ওপরও আঘাত হানে।
নিরলসভাবে ফিলিস্তিনি জলপাইবাগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো মধ্যে ইসরায়েলের এই পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা প্রতিফলিত হয়।
১৯৬৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের প্রায় ৮ লাখ জলপাইগাছ উপড়ে ফেলেছে।
দখলদার যতই ফিলিস্তিনিদের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, ফিলিস্তিনিরা ততই অস্তিত্ব টেকাতে উদ্ভাবনশীল হয়ে উঠেছে
আদি পুরুষের ভূমির সঙ্গে এই সংযোগ আমাদের প্রবাসী ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও রয়েছে। আমি নিজে পশ্চিম তীরের নাবলুসে জন্মেছি, কিন্তু বেড়ে উঠেছি ফিলিস্তিনের বাইরে।
দূরে থাকলেও আমি কখনোই ফিলিস্তিনি ভূমির সঙ্গে আমার নাড়ির টান অনুভব করা বন্ধ করিনি।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় আমার পরিবারকে ভিটা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমার বাবা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে তাঁর বাবার জমি লুট করতে এবং সেই জমিকে সামরিক চেক পয়েন্টে পরিণত করতে দেখেছিলেন।
আমার মাকে কাজে যাওয়ার পথে বসতি স্থাপনকারীরা গুলি করেছিল। আমার বাবা–মা পরে দেশ ছাড়েন। এটি তাঁদের ইচ্ছাকৃত দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত ছিল না।
শুধু জানেন, বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের দেশ থেকে চলে যেতে হয়েছিল।
দুই দশক ধরে আমি নিয়মিতভাবে ফিলিস্তিনে গিয়েছি। সেখানে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করতে এবং ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিতে দেখেছি।
আমি ছোটবেলায় যে জায়গাগুলোকে ইসরায়েলিদের দখল করে বাড়ি তৈরি করতে দেখেছিলাম, সে জায়গাগুলো এখন পুরোদস্তুর শহরে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি পাড়া–মহল্লাগুলোকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
কিন্তু আমি এক দিকে যেমন ফিলিস্তিনি জলপাইগাছ পুড়তে দেখেছি, ফিলিস্তিনিদের পানি চুরি হতে দেখেছি এবং ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ভাঙতে দেখেছি; অন্যদিকে আমি তাদের রুখে দাঁড়ানো ও বিদ্রোহও দেখেছি।
ইসরায়েলিরা পানির সরবরাহ লাইন কেটে দেওয়ার পর পানি সংরক্ষণের জন্য ফিলিস্তিনিরা ট্যাংক তৈরি করছে; বোমায় ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ার পর রাতে নিজেরা ঘর পুনর্নির্মাণ করছে এবং ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে সাহায্য করার জন্য অন্য পরিবারগুলো ছুটে এসেছে।
গত বছর ইসরায়েলি সহিংসতা গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মনোবল টলেনি। তারা ভেঙে পড়েনি। জেনিন থেকে গাজা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা কোনোরকমে টিকে থেকে ইসরায়েলি হামলা ও বোমাবর্ষণের মধ্যেই প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই নিরন্তর অমানবিকতা আমাদের কমিউনিটির মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গাজার মানুষ যখন গণহত্যার মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের হাল ছাড়ার কোনো অধিকার নেই। আমাদের নিজেদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং অন্য সমাজকে জানাতে হবে যে আমরা আছি, আমরা বেঁচে আছি এবং আমরা এমন এক পৃথিবীতে টিকে থাকব, যে পৃথিবী আমাদের মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
দখলদার যতই ফিলিস্তিনিদের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, ফিলিস্তিনিরা ততই অস্তিত্ব টেকাতে উদ্ভাবনশীল হয়ে উঠেছে।
সাইকেল দিয়ে চালিত ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচা, কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাটির চুলায় রুটি বানানো, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে জেনারেটর বানানো তাদের মনোবলের দৃঢ়তাকে স্পষ্ট করে।
এদিকে আমরা যাঁরা প্রবাসে আছি, তারা কখনোই ফিলিস্তিনকে ভুলিনি। আমরা বেদনা ও আতঙ্কের সঙ্গে গণহত্যার ঘটনা দেখছি।
আমাদের আশ্রয় দেওয়া দেশগুলোর নেতাদের চোখ বুজে থাকাও দেখছি। আমরা এখানে থেকে বুঝতে পারি, পশ্চিমের অনেকেই ফিলিস্তিনি জীবনের মূল্যে বিশ্বাস করে না। তারা আমাদের মানুষই মনে করে না।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই নিরন্তর অমানবিকতা আমাদের কমিউনিটির মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গাজার মানুষ যখন গণহত্যার মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের হাল ছাড়ার কোনো অধিকার নেই।
আমাদের নিজেদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং অন্য সমাজকে জানাতে হবে যে আমরা আছি, আমরা বেঁচে আছি এবং আমরা এমন এক পৃথিবীতে টিকে থাকব, যে পৃথিবী আমাদের মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
‘আমরাই জমি’—এই রূপকটি শুধু কবিতায় ব্যবহার্য জিনিস নয়। এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য বাস্তবতা।
যখন ফিলিস্তিনিদের জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তোমরা কেন চলে যাচ্ছ না?’ তখন তারা উত্তর দেয়, ‘আমরা কেন যাব?’
এটি ফিলিস্তিনি জমি। এই জমি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের রক্ত ও অশ্রু দিয়ে চাষ করা হয়েছে।
এই জমি ছেড়ে দেওয়া মানে সবকিছু হারানো। এই জমি ছেড়ে যাওয়া মানে আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আমাদের সামষ্টিক আত্মাকে মুছে ফেলতে দেওয়া।
এক বছর ধরে চলা এই গণহত্যার মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা নিজের জমিতেই থেকে গেছে; কারণ তারা থাকতে বাধ্য।
Sharing is caring!