সম্পাদকীয়:
অক্টোবরের ৯ তারিখ হইতে ১৩ তারিখ অবধি বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হইবে। এইবার সমগ্র দেশে প্রায় সাড়ে ৩১ হাজার পূজামণ্ডপে পূজা উদ্যাপিত হইবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, এই সকল পূজামণ্ডপে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করিয়াছে। পূজার পূর্বে প্রতিটি জায়গায় টহল বাড়াইবার কথা বলা হইয়াছে। ইতিমধ্যে আনসার ও ভিডিপি মোতায়ন করা হইয়াছে। বোধন এবং ষষ্ঠীপূজা হইতে সকল পূজামণ্ডপে আনসার ও ভিডিপি দায়িত্ব পালন করিবে। ইহা ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মোতায়ন রহিয়াছেন-তাহারাও পূজার দায়িত্ব পালন করিবেন। সার্বিকভাবে আশা করা যায়, দেশের সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নির্বিঘ্নে তাহাদের উৎসব পালন করিতে পারিবেন।
আমাদের মনে রাখিতে হইবে, একটি দেশ কতখানি সভ্য ও উন্নত মানসিকতার, তাহা অনুধাবন করা যায় ঐ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ কতখানি নিরাপদ ও ভালো আছেন-তাহার উপর। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলিয়া মিশিয়া শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকিবার হাজার বৎসরের সংস্কৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের: কিন্তু সেই গৌরবের সংস্কৃতিতে কালিমা লেপনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটিতে দেখা যায়। প্রায়শই মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগের অল্পবিস্তর ঘটনা পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মন্দিরে আক্রমণের ঘটনায় আমরা বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছি। আমরা দেখিয়াছি, এই ধরনের দুর্বৃত্তায়নের ঘটনা অধিকাংশই ঘটিয়াছে সেই সকল অঞ্চলে, যেইখানে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট দৃঢ়তার সহিত দায়িত্ব পালন করে নাই। অন্যদিকে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন। দেখা যায় যে, বিভিন্ন মন্দিরে আক্রমণ চালাইয়া অগ্নিসংযোগ ও প্রতিমা ভাঙচুর করিবার ঘটনাগুলি ঘটিয়া থাকে রাতের আঁধারে। তাহার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত জনগোষ্ঠী দুর্বৃত্তদের সম্পর্কে পুলিশকে বিশেষ কিছু জানাইতে পারে না।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের আরেকটি দিকও রহিয়াছে। তাহা হইল দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মাধ্যমে অতীতে এই সকল অপকর্ম ঘটাইবার উদাহরণ রহিয়াছে। নানা কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় তাহাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করিতে ব্যর্থ হয়; কিন্তু এই ধরনের ঘটনা সমাজে মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া থাকে। বহির্বিশ্বেও নেতিবাচক বার্তা যায়। বাংলাদেশে সকল ধর্মবর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থানের যেই ঐতিহ্য, সহনশীল পরিবেশে সকলের নিরাপদ জীবন-যাপনের যেই অঙ্গীকার- তাহা যে কোনো প্রকারে রক্ষা করিতে হইবে। এই গুরুদায়িত্ব স্থানীয় জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
আশার কথা হইল, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার ও প্রশাসন সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি প্রশংসনীয় দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছে। কোনো মহল হীনস্বার্থে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াইতে যদি রাতের আঁধারে প্রতিমা ভাঙচুর করে, সংখ্যালঘুদের মনে ভীতির সঞ্চার করে, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের পাঁয়তারা করে-তখন অতিসত্বর এই সকল দুর্বৃত্তকে ধরিয়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হইলে সংখ্যালঘুদের মনে এই বিশ্বাস সঞ্চারিত হইবে যে, সরকার ও প্রশাসন এই ধরনের অপরাধ বরদাস্ত করে না। ইহা দুর্বৃত্তদের নিকটও কঠোর বার্তা প্রদান করিবে। সুতরাং কুচক্রী মহল যাহাতে কোনো অজুহাতে সরকারের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করিতে না পারে সেই জন্য স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনকে সর্বদা সজাগ থাকিতে হইবে। ইলেকট্রনিকস বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কেহ যেন মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব ছড়াইতে না পারে-সেই দিকেও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) সদাসতর্ক থাকিতে হইবে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা পাইবার সাংবিধানিক অধিকার রহিয়াছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যাহা-ই হউক না কেন, আইন যেমন সকলের জন্য সমান, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, উৎসব করিবার স্বাধীনতাও সকলের বেলায় সমান। এইখানে কোনো ধরনের বৈষম্য কাম্য নহে।
Sharing is caring!