স্টাফ রিপোর্টার:
গত এক মাসের ব্যবধানে বিয়ানীবাজার থেকে অন্তত: ২০টি প্রেমিক জুটি পালিয়ে গেছেন। কেউ আবার অন্য উপজেলা থেকে মনের মানুষকে নিয়ে এসেছেন, কেউ ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে অন্য স্থানে চলে গেছেন। আদরের সন্তানের এমন বখে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে বইছে বিষাদের রোল, কোন পরিবারে বাড়ছে বিভক্তি। সামাজিকতার চক্ষু রাঙ্গানী আর খেদোক্তি থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের কেউ বাইরে বের হচ্ছেননা। এ যেন কঠিন নির্মম-বাস্তবতা। হঠাৎ করে বিয়ানীবাজারে প্রেম-বিয়ে কিংবা অসম প্রেম বৃদ্ধি পাওয়ায় অস্বস্থিতে আছেন এখানকার অভিভাবকসহ সচেতন মহল। কেউ বিপথগামী সন্তানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন আবার কেউ আছেন নীরবতার চাদরে মোড়া।
কেস স্টাডি: ১
শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার পাড়িয়াবহর থেকে এক পিতা এসেছেন মেয়ে নিখোঁজের বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়রী করতে। তার সাড়ে ১৫ বছরের মেয়ে জকিগঞ্জের কালিগঞ্জের এক ছেলের হাত ধরে অজানায় চলে গেছে। মেয়ে উদ্ধারে তিনি অসহায়ভাবে পুলিশের সহায়তা চাইছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়ে উদ্ধারে চেষ্টা করা হবে বলে ওই পিতাকে আশ্বস্থ করা হয়। এরপরও কাঁদছেন পিতা। কারণ যে ছেলের সাথে তার মেয়ে পালিয়েছে ওই ছেলে তার মেয়ের উপযুক্ত নয়।
কেস স্টাডি: ২
উপজেলার এক নিভৃত এলাকায় বহিরাগত এক কার চালক ধণাঢ্য পরিবারের এক মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। তার বাড়ি-ঘর কিছুই নেই। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে তাকে চালক ও তার পরিবার। অসম এই লাভ ম্যারেজে ছেলেকে এলাকার কিছু দুষ্কৃতিকারীও সহায়তা করেছে। মেয়েকে ফিরে পেতে পাগলপ্রায় অভিভাবক। তাদের চোখের নিচে ক্লান্তি আর হতাশার কালি।
কেস স্টাডি: ৩
সম্প্রতি বিয়ানীবাজার থেকে অপহৃত এক কিশোরীকে (১৭) শাহপরাণ এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপহরণের প্রায় তিন সপ্তাহ পর ৪ অক্টোবর রাতে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় তাওহিদ হোসেন ইমন (১৯) নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি শাহপরান থানার সুরমা গেইট ধলইপাড়ার মো. দুলাল মিয়ার ছেলে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর ওই কিশোরীর মা বাদী হয়ে থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অবশেষে শুক্রবার রাতে অপহৃত কিশোরীর অবস্থান শনাক্ত করে শাহপরাণ থানার একদল পুলিশ ওই কিশোরীকে উদ্ধার এবং অভিযুক্ত ইমনকে গ্রেফতার করে। পরে কিশোরীকে চিকিৎসার জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনায়ও প্রেমের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে এলাকা সূত্রে জানা গেছে।
বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলায় প্রেম এবং পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেজনক হারে বেড়েছে। এক্ষেত্রে লোকলজ্জার ভয়ে খুব কমসংখ্যক অভিভাবক প্রতিকার চাইতে থানায় আসেন। শুধুমাত্র অসম প্রেমের ক্ষেত্রে কোন কোন অভিভাবক আইনী প্রতিকার চান। বর্তমানে তরুণী নিখোঁজের বেশ কয়েকটি ঘটনা থানা পুলিশ তদন্ত করছে।
প্রেমের বিয়েতে মোহ কাজ করে। ভালোমন্দ, লাভক্ষতি—কোনো কিছুই চোখের সামনে দেখা দেয় না। অন্ধত্ব পেয়ে বসে। ছেলেমেয়ে দুজনেই তাদের দায়দায়িত্ব ভুলে গিয়ে ভালো লাগা নিয়েই সবকিছুতে বিভোর থাকে। পরিবার–পরিজন তখন গৌণ হয়ে যায়। বাবা-মা তখন না পেরে মুখ বন্ধ করে থাকেন। তাঁরা হাজারো ভালো পরামর্শ দিলেও সেসব ভালো লাগে না প্রেম–জুটির। প্রেমের বিয়ে নিয়ে সমাজে বেশ রসিকতা, কানাঘুষা চলে। প্রেমে পড়াটা সম্পূর্ণ একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। প্রেম মানেই জীবনের নতুন রোমাঞ্চ শিহরণ ভরা রোমান্টিক ইনিংসের শুরু।
এ বিষয়ে কুড়ারবাজার কলেজের প্রভাষক বিজিত আচার্য জানান, বিয়ের আগে জীবনটাকে রূপকথাই মনে হয়। বিশেষ করে মনের মানুষটার সাথে প্রেম করে বিয়ে হওয়ার সময়ে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই সব মেয়ে আবিষ্কার করেন যে জীবন রূপকথা নয়। এখানে হ্যাপিলি এভার আফটার হয় না। তিনি বলেন, প্রেম করে বিয়ে হলে কিছু কারণে চাপটা অনেক বেশী থাকে। মনে হয় সকলের নজর যেন তাদের ওপরেই। শ্বশুরবাড়ি থেকেও চাপ থাকে।
একটু ভিন্নভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করলেন বিয়ানীবাজারে কর্মরত আইনশৃংখলা বাহিনীর এক সদস্য। ‘ছেলেমেয়ের জন্য উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ বাবা-মায়ের জন্য। তারা বড় হয়েছে। নিজেদের জীবনসঙ্গী নিজেরা পছন্দ করে নিলেই বরং আমরা কঠিন এই দায়িত্ব থেকে রেহাই পাই!’ মজার ছলেই হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
কানাডা প্রবাসী রম্য লেখক ফুজেল আহমদ বলেন, প্রেম ভালোবাসা আদিকালে ছিল অনন্তকাল থাকবে। প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এর ধরনটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সময়ের প্রেম বড়োই ঠুনকো হয়ে গেছে। এর কোনো গভীরতাই নেই। নেই কোনো আকার। সামান্য কারণেই তা শেষ হয়ে যায়। একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরাটা নিয়ম হয়ে গেছে। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই হয়তো তা পূর্ণতা পায়।
বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে পড়ুয়া এক ছাত্রীর পিতা হোসেন আহমদ বলেন, বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রেম হয়তো স্বাভাবিক কিন্তু আমাদের জন্য তা অবাক হওয়ার বিষয় বটে। সামাজিক মর্যাদা-অসম্মান বয়ে বেড়াতে হয়ে বছরের পর বছর। তাছাড়া আবেগে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক সময় পরে পস্তাতে হয়। এতে অনেক সময় বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে।
পৌরশহরের পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাওলানা হুমায়ুন রশিদ বলেন, পবিত্র কোরআনে নারী-পুরুষের বিয়েবহির্ভূত প্রেম-ভালোবাসা হারাম ঘোষণা করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যিনা তথা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।
মানবাধিকার সংগঠক ও আইনজীবি এডভোকেট মো: আমান উদ্দিন অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। তাকে গুণগত সময় দিন। সারা দিন কী করছে, কোথায় গেছে, কী খেয়েছে—এসব খবর রাখুন। তবে সেটা যেন খবরদারি না হয়। সন্তানকে প্রাইভেসি দিন। ওর আবেগকে সম্মান করুন। ওর মনটা বুঝতে চেষ্টা করুন। তার ইচ্ছা–অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিন।
Sharing is caring!