প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
৮ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

বিয়ানীবাজারের পাল রাজবাড়ি ইতিহাসের স্মারক

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ১২:১৫ অপরাহ্ণ
বিয়ানীবাজারের পাল রাজবাড়ি ইতিহাসের স্মারক

 

স্টাফ রিপোর্টার:

সিলেট অঞ্চলে পাল রাজবংশের অন্যতম স্মারক বিয়ানীবাজারের পাল রাজবাড়ি। ইতিহাস সন্ধানী ভ্রমণপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই পাল জমিদার বাড়ি ও এখানকার বারোপালের দিঘি প্রিয় স্থান। পাল রাজবাড়ির উত্তরসূরি ভূপতিভূষণ পাল চৌধুরীর মেয়ে সুস্মিতা পাল চৌধুরী জানান, প্রাচীন এই বাড়ির বয়স প্রায় আটশ বছর।

বিয়ানীবাজারের আদি নাম ছিল চন্দ্রপুর। সে সময়ে এই অঞ্চলে টেঙ্গুরী নামে পাহাড়ি নাগা ও কুকি সম্প্রদায় বসবাস করে আসছিল। তারা এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের এই রাজ্যের নাম ছিল টেঙ্গইর রাজ্য। দশম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে পাল বংশীয় রাজা কালিদাস পাল এই টেঙ্গইর জাতিকে বিতাড়িত করে এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই রাজ্যের নাম দেন পঞ্চখণ্ড। যার সীমানা ছিল মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা পর্যন্ত। সে সময়ে খাসা এলাকায় স্থাপন করা হয় রাজবাড়ি। খনন করা হয় প্রকাণ্ড বারোপালের দীঘি।

 

সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলের শেষের দিকে পঞ্চখণ্ডে পাল রাজত্ব বহাল ছিল। তখন এই অঞ্চল রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল। পাল রাজা কালিদাসের পর সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে তারা এখানে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন স্বাধীনভাবে। সেই সময়ে কাউকেই রাজস্ব দিতে হয়নি। পাল রাজা বারাণসীপালের সময় তিনি রাজবাড়ির পূর্ব দিকে একটি প্রকাণ্ড দিঘি খনন করেন, যা বারোপালের দিঘি নামে খ্যাত।

 

পাল রাজারা ছিলেন প্রজাহিতৈষী। প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য তারা বারোপালের দীঘিসহ বেশ কয়েকটি দিঘি খনন করেন। শিক্ষার প্রসারে তারা প্রথম রুক্ষিণী মোহন এমই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পঞ্চখণ্ডে পাল শাসনকাল ছিল প্রায় একশ বছর। পরবর্তী সময়ে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (র.)-এর সিলেট বিজয়ের মধ্য দিয়ে ওই জনপদ মুসলিম শাসনের আওতাভুক্ত হয়। তারপর রাজা কালিদাস পালের নিয়ন্ত্রণে এখানে কয়েকটি জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে পাল রাজবাড়ি পাল জমিদার বাড়িতে পরিণত হয়।

চন্দ্রপুর থেকে পঞ্চখণ্ডের পর বিয়ানীবাজার নামকরণ অনেক পরে হলেও এই নামকরণে পাল রাজাদের অবদান রয়েছে। গহিন জঙ্গল আর টিলাবেষ্টিত এই জনপদে তখন ছিল হিংস্র প্রাণীর বিচরণ। প্রথম ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবপ্রাপ্ত হরেকৃষ্ণ রায় বাহাদুরের পুত্র কৃষ্ণকিশোর পাল চৌধুরী একটি এলাকাকে জঙ্গল মুক্ত করে বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। হিংস্র প্রাণীর ভয়ে সকাল বেলা কেনাকাটা করে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে যেত মানুষ। কথিত আছে, এসব কারণেই বাজারটির নাম হয়ে যায় ‘বিহানী বাজার’ এবং পরে আজকের বিয়ানীবাজার।

সম্পূর্ণ রাজবাড়িটি এখন নেই। শুধু মন্দিরের অংশটি বিদ্যমান। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বাড়িটির অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। গাছ-গাছালিতে ঢাকা পড়েছে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী। এখনও প্রতিদিন পাল রাজবংশের স্বাক্ষর এই বাড়ি দেখতে আসেন অনেকে। আর রাজবাড়ীর পূর্বদিকে বিয়ানীবাজার সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে রাজা বারাণসী পাল কর্তৃক খননকৃত বারোপালের দীঘির পাড়ে ও ঘাটে বসে প্রতিদিন দীঘির সৌন্দর্য উপভোগ করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি খালেদ জাফরি বলেন, পাল রাজবাড়ি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বিয়ানীবাজারে পাল রাজবংশের অনেক অবদান রয়েছে। এটিকে সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণ করলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাসের স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। ইতিহাস সন্ধানী ও পর্যটকদের কাছে এটি পর্যটন স্থান হিসেবে আরও বেশি প্রিয় হবে।

বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান বলেন, পর্যটন স্থান হিসেবে পাল রাজবাড়ির গুরুত্ব অনেক। দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনাকে পর্যটন স্থান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু বিয়ানীবাজারের কোনো স্থান বা স্থাপনা এসবের মধ্যে নেই। ঐতিহাসিক কারণে এটিকে পর্যটন স্থান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

স্থানীয় দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার বলেন, বিয়ানীবাজারে কোনো পার্ক বা উদ্যান নেই। তবে কয়েকটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা আছে। তার মধ্যে পাল রাজবাড়ি অন্যতম। যদিও পাল বংশের উত্তরসূরিরা এখনও এই বাড়িতেই আছেন। তবে সরকার চাইলে তাদের অন্যত্র জমি দিয়ে সরিয়ে নিয়ে এই বাড়িটিকে পর্যটন স্থান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। বাড়িটিকে সংস্কার করে আকর্ষণীয় করে তুললে এটি প্রাচীন পঞ্চখণ্ডের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

পাল রাজবাড়ির উত্তরসূরি ভূপতিভূষণ পাল চৌধুরীর কন্যা সুস্মিতা পাল চৌধুরী বলেন, এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী। এটিকে সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে বিয়ানীবাজারে পাল রাজবংশের ঐতিহ্য রক্ষা পাবে। সরকারিভাবে এই বাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন, পাল রাজবাড়ি বিয়ানীবাজারের ঐতিহ্যের স্বাক্ষর। কিন্তু এটি ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাল বংশের উত্তরাধিকারীরা এখনও আছেন এবং এই বাড়িতেই অবস্থান করছেন। তারা নিজে উদ্যোগী হয়ে বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে দিলে এটি পর্যটন স্থান ও স্থাপনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Sharing is caring!