মিলাদ মো. জয়নুল ইসলাম:
মানুষ মাত্রেরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে কিছু মানুষ সীমা পেরিয়ে অসীম গন্তব্যের যাত্রী হন। তাঁরা বিশালত্বের অধিকারী হয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেন। আর এতেই আস্থার প্রতিষ্টানে পরিণত হন তাঁরা। বর্ণিল দক্ষতায় তৃপ্ত হয়ে ওঠে তাঁদের জীবন। সেই জীবনের দীপ্তিময় ক্ষণ পাড়ি দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার আহবানে একসময় মরণের ওপারে চলে যান তাঁরা। সময়ের সেই আহবানে বিয়ানীবাজারবাসী মহিরুহ ব্যক্তিদের হারিয়ে এখন অভিভাবকশূণ্য। ক্রমেই যেন অচেনা জনপদে পরিণত হচ্ছে প্রিয় শহর।
পঞ্চখন্ড তথা এখনকার বিয়ানীবাজারের চলমান বিশ্বকোষ, জীবন্ত ইতিহাসজন জাগতিক নিয়মেই হারিয়ে যাচ্ছেন। অসংখ্য মানুষের মনের ভাসানচরে থিতু হওয়া বিশিষ্ট সালিশ ব্যক্তিত্ব ও দীর্ঘমেয়াদী পৌর প্রশাসক তফজ্জুল হোসেনও পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। জানি আর কোনোদিন আপনি বলবেননা- ‘মিলাদ ওগু কই বে, ফোন দে ওগুরে’। কিংবা ফোন দিয়েই বলবেননা -‘ কই বেটা তুই?’ জীবনের পড়ন্ত সময়েও অনেক পরামর্শ দিয়েছো চাচা, যা পথ চলার পাথেয় করে স্মরণ রাখবো। আপনার চলে যাওয়া আমার জন্য গভীর বেদনার। বিদায়-আমার জৈবিক সফলতার উজ্জ্বল তারকা।
এর আগে মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধানে ইহকালকে বিদায় জানিয়ে পরকালকে স্বাগত জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী এম এ মান্নান। সাম্প্রতিক সময়ে পরাপারে পাড়ি জমিয়েছেন বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুলতান কবির চুনু। সাম্প্রতিক অতীতে বিশিষ্ট রাজনীতিক হাজী এম এ রাজ্জাক, সাহিত্যিক আবদুল হেকিম তাপাদারও চলে গেছেন অনন্তলোকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা হারিয়েছি সালিশ ব্যক্তিত্ব আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া তাপাদার, কবি ফজলুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালীক ফারুকসহ অনেক কৃতিজন। আপনাদের সময়ে পরমত সহিষ্ণুতা বিকশিত হতো। মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর সত্যের স্বীকৃতি দেয়া হতো। আপনাদের সবার মধ্যে এক অন্ত্বমিল ছিল। আপনারা ছিলেন পুষ্পবৃক্ষ, যারা ছায়ায় গেছে তারা কেবল সুঘ্রাণ পেয়েছে। আমরা না হয় ব্যর্থ, অযোগ্য, অসফল; তাই বলে এভাবে কোনো কিছু না বলে, অচেনার দূরত্ব মেখে চলে যাবেন আপনারা! এখন অসূস্থ হয়ে অনেকটা ঘরবন্দি শিক্ষাবিদ আলী আহমদ, শিক্ষাবিদ মজির উদ্দিন আনসার, লাউতার সাবেক চেয়ারম্যান এম এ জলিল, যুক্তরাষ্ট্রে গুরুতর অসূস্থ আজমল হোসেন, আব্দুল হাছিব মনিয়া। তাঁদের সূস্থতা কামনা করছি।
আমরা ভাবছি আবার শঙ্কিত হচ্ছি, বিয়ানীবাজারবাসীর আশ্রয়স্থল ও বোধের জগৎ শূন্য হচ্ছে। সমাজ সংস্কারক কণ্ঠস্বর হচ্ছে ক্রমশ বিলীন। আগামী প্রজন্ম-যাঁরা খুঁটি হিসেবে ধরতে চান যাঁদের, আশ্রয় পেতে চান যাঁদের কাছে- তারা পথহীনতায় দিশেহারা হবেন। সমাজপতিদের জন্মভূমি গভীর ক্ষতে এতিম। সুস্থ সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা যখন উধাও হয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের ভিত্তির শিকড়ও ঘুণ ধরছে।
চিন্তা করছি, আমরা যাদের হারাচ্ছি তাঁরা আমাদের মনমানসে নানাভাবে সঞ্চারিত। তাঁরা প্রতিবাদী। তাঁরা উদ্দীপ্ত, সংগ্রামী। তাঁরা উন্নতশির। তাঁরা মানুষের সহমর্মী, সহকর্মী। সুখ-দুঃখে সঙ্গী, ভয়ডরহীন। তাঁরা আমাদের পূর্বসূরী। তাঁরা চলতেন বোধবুদ্ধি নিয়ে, মাথা সজাগ রেখে। তাঁরা চটজলদি পথ বাতলে দিতেন। তাঁরা বহুমানিত। শত বছরে এই জনপদে তাঁদের মত আর কারোও জন্ম হবে কিনা মহান আল্লাহই ভালো জানেন ৷ তবে এই সমাজবাসীর যাপিত জীবনে তাঁদের খুব প্রয়োজন ৷ কে নেবে সেই বোঝা?
যত অপূর্ণতাই তাদের থাকুক না কেন, আমাদের সম্ভাব্য সব পূর্ণতা নিয়েও তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করে উঠতে পারবো না। তাঁরা দূরে যাননি। তাঁদের প্রস্থানে, সবার্থেই, একে একে নিবিছে দেউটি, দীপ জ্বালানোর থাকছে না কেউ।
তবুও আশা আছে-যে স্বপ্নযাত্রা আপনারা শুরু করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে না…
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।
Sharing is caring!