
স্টাফ রিপোর্টার:
যুগে যুগে মহান আল্লাহ পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচারে প্রেরণ করেছেন অসংখ্য বুজুর্গ ব্যক্তি। যাঁরা পরবর্তীকালে সর্বত্র ছড়িয়েছেন ইসলামের আলো। এসব মহান সুফি-সাধকের হাত ধরে অগণিত পথহারা মানুষ পেয়েছেন দীন ইসলামের আলো। আর সেই অনুসারীরাই তাঁদের বুজুর্গদের প্রতি ভালোবাসা এবং স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে সমবেত হন অলি-আউলিয়াদের মাজারে। তেমনি একটি ঐতিহ্যমন্ডিত মাজার সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামে অবস্থিত। জাগতিক সব নিয়ম ভঙ্গ করে ওই মাজারে পূর্ব-পশ্চিমে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হযরত গোলাবশাহ (র.)।
স্থানীয়রা জানান, উত্তর-দক্ষিণে হযরত গোলাবশাহ (র.)-কে দাফন করলে তাঁর নির্মিত মসজিদটি পায়ের পিছনে পড়ে যাবে-এমন আশঙ্কা থেকে জীবদ্দশায় তাঁকে পূর্ব-পশ্চিমে শায়িত করার ওসিহত করেন তিনি। কিন্তু ইসলামের বিধান মেনে মৃত্যুর পর হযরত গোলাবশাহ (র.)-কে উত্তর-দক্ষিণে দাফন করার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাজারটি আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ব-পশ্চিমমুখি হয়ে যায়। সরজমিন মাজারের পূর্ব-পশ্চিমমুখি অবস্থান দেখতে প্রতিদিন শ’ত-শ’ত মুসল্লীয়ান সেখানে ভিড় করেন।
হযরত গোলাবশাহ (র.) প্রকল্প ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নিপু জানান, ৩৬০আউলিয়ার দেশের এই মহান ওলী হযরত গোলাবশাহ (র.) মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল শাহ বাবুল খাঁ। বাবুল খাঁ দুই ছেলে ও স্ত্রীকে রেখে জান্নাতবাসী হন। হযরত গোলাবশাহ (র.) শৈশবে গ্রাম্য মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। গোলাবশাহ (র.) জনসাধারণের কাছে মওজুফ পাগলের মত পরিচিত ছিলেন।
ওয়াক্ফ এস্টেটের প্রকল্প কমিটির সদস্য নজরুল হোসেন জানান, এই ওলী অসংখ্য বিনিদ্র রজনী বনে জঙ্গলে কাটিয়েছেন। বনের লতা পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন। অবশেষে তাঁর জীবনে ডাক আসে বিয়ানীবাজারের পঞ্চখন্ডের ইমামবাড়ীর পবিত্র মাটিতে। একদা কসবা গ্রামের ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে আসার পথে ঘিলাছড়া জঙ্গলে তাঁকে দেখতে পেয়ে সাথে নিয়ে রওয়ানা দেন। সেসময় ছিল বর্ষাকাল। ঘিলাছড়া থেকে গন্তব্যে নৌকা আসতে প্রায় দুইদিনের দীর্ঘ সময়ের যাত্রা। নৌকায় আরোহন করে গোলাবশাহ বলতে লাগলেন ওরে বাতাস আমাকে ধরে নে। প্রবল বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে লাগল মাঝি নৌকায় পাল তুলল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ওই নৌকা ইমাম বাড়ীর ঘাটে এসে পৌছে যায়। তাঁর কারামতের অনেক ঘটনাবলীর নিদর্শন বিস্ময়কর। তিনি সর্বদা এবাদতে মশগুল থাকতেন। তাঁর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়েছিলেন দিঘীরপার খাসা মৌজার দুর্দান্ত প্রতাপ চন্দ্র পাল। এই পাল বংশই বর্তমান বাহাদুরপুর জমিদার বংশের পূর্ব পুরুষ প্রসন্ন কুমার পাল চৌধুরী। তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
জানা যায়, হযরত গোলাবশাহ (র.) কসবার ইমামবাড়ীতে এসে একটি পুকুর খনন করে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি নিজে ইমামবাড়ীতে মসজিদ নির্মাণ করার জন্য ইট পুড়ে চুন-সুরকি ও কংক্রিট দিয়ে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। মসজিদ নির্মাণকালে সহযোগী শ্রমিকরা তাদের পারিশ্রমিক তাঁর কাছে চাইলে তিনি চটের বিছানার নীচ থেকে নিয়ে যেতে বলতেন। শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য টাকা সেখান থেকে নিয়ে যেত। আশ্চর্যের বিষয়, হযরত গোলাবশাহ (র.) মসজিদ নির্মাণের জন্য কারো কাছে কখনো টাকা পয়সা চাননি। তিনি প্রতি শুক্রবার মসজিদে শিরণী বিতরণ করতেন। চুন, সুরকির মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ছিল। হযরত গোলাবশাহ (র.) মসজিদ নির্মাণ করার জন্য নিজে ইট পুঁড়েন এবং ছাতক থেকে নৌকায় করে চুন নিয়ে আসেন। ৩ লাইনের মসজিদে ১৩ জন করে মোট ৩৯ জন মুসল্লী সেসময় একসাথে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারতেন। এটি ১৯৮৮ সালে আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে পূণঃনির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে ওই মসজিদকে কেন্দ্র করে এখানে ওয়াক্ফ এস্টেট গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও হাফিজিয়া মাদ্রাসা, ছাত্রাবাস, মাজার কমপ্লেক্স, পাঠাগার, মৎস্য খামার, এতিমখানা, ঈদগাহসহ বিভিন্ন প্রকল্প চলমান আছে। পুরো এলাকাটি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। এখানকার সারি-সারি বৃক্ষরাজি, নয়নাভিরাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশ যেমন হৃদয়ে প্রশান্তি আনে ঠিক তেমনি সুললিত কোরআন তেলাওয়াতের সুর যে কাউকে বিমোহিত করে। ১.৭১ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হযরত গোলাবশাহ্ (র.) প্রকল্প ওয়াকফ এষ্টেট (ইমামবাড়ী) অত্র এলাকার একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
হযরত গোলাবশাহ (র.) হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হাফিজ মোস্তাক আহমদ বলেন, হযরত গোলাবশাহ (র.) কখনো ডুব দিয়ে গোসল করতেননা। কিন্তু একদিন গোসল করতে নেমে ডুব দিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি পরে ওঠলেন। ততক্ষণে জুমার নামাজ শেষ হয়ে গেছে। উপস্থিত মুসল্লীরাও তাঁর অপেক্ষা না করে নামাজ আদায় করে নেন। নামাজ শেষে পুকুরপারে যখন মুসল্লীরা তাঁর খোঁজে সমবেত হন তখন তিনি ওঠে গেলেন। একপর্যায়ে উপস্থিত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে বললেন, কেউ কোন প্রশ্ন করবেনা। আমি মক্কা শরীফে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করে এসেছি। সেই থেকে পুকুরটিও স্থানীয়দের কাছে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে।
Sharing is caring!