প্রজন্ম ডেস্ক:
দেশের গণপরিবহন খাত এখনো জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দেশের পটপরিবর্তনে এক সিন্ডিকেটের বিদায় হলেও আরেক সিন্ডিকেট জেঁকে বসেছে গণপরিবহনে। পরিবহনসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নেও পরিবর্তন ঘটেছে। যাত্রীদের জিম্মি করে সেই ভাড়া নৈরাজ্য, টার্মিনাল বা স্ট্যান্ড দখল, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, রুট অনুযায়ী বাস চলাচলে একচেটিয়া প্রভাবসহ নানা অপকর্ম এখনো চলছে। তার মাঝে আবার নতুন এ বছরে বাসের ভাড়া আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল পুরো পরিবহন খাত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবহন খাতের সিন্ডিকেটেও ঘটেছে পরিবর্তন। আওয়ামী সিন্ডিকেট পালালে এখন সেই জায়গায় আসীন হয়েছেন আওয়ামীবিরোধী পরিবহন ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। তারাও সেই আগের কায়দায় নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। তারা আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের পরিবহন কোম্পানি বা বাসগুলো নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে ভিন্ন নামে পরিচালনা শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা পরিবহন খাতের মাফিয়ারা বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবহন ব্যবসায়ীদের ঠিকমতো ব্যবসাও করতে দেননি বলে অভিযোগ আছে। একচেটিয়া প্রভাবের কারণে প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল দেশের পরিবহন খাত। কোনোভাবেই দখলদারি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের লাগাম টানা যাচ্ছিল না এই সেক্টরে। সিন্ডিকেটের কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে গণপরিবহনের ভাড়াও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর ইস্কাটনে বহুতল ভবন ইউনিক হাইটসের চতুর্থ তলায় ঢাকা সড়ক পরিবহন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশ সুসজ্জিত অফিস। বিগত সরকারের আমলে এখান থেকেই দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সরকার পতনের পর ১৩ আগস্ট কার্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত একাধিক পরিবহন নেতা।
এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মালিক সমিতির কার্যালয় ছিল মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনে। বছর ছয়েক আগে ইউনিক হাইটসে আট হাজার বর্গফুটের এ অফিস নেওয়া হয়। এর সাজসজ্জায় ব্যয় হয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সারা দেশের পরিবহন খাত থেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হতো। গেট পাস বা জিপি কিংবা সমিতির সদস্য ফিসহ নানা অজুহাতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট পরিবহন নেতারা সাধারণ বাস-ট্রাকমালিকদের কাছ থেকে দৈনিক, মাসিক ও এককালীন নানা অঙ্কের টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করতেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহসহ আরও বেশ কয়েকজনে মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই সেক্টরে গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট প্রতিদিন সারা দেশের চলাচল করা গণপরিবহন থেকে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি করত। চাঁদাবাজির টাকায় ওই তিন ‘মাফিয়া’ বিগত সরকারের আমলে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। খন্দকার এনায়েত উল্যাহর সহযোগী ছিলেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়েছেন এনায়েত উল্যাহ। অন্যদিকে আত্মগোপনে আছেন জাতীয় পার্টির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা রাঙ্গা।
জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে প্রায় ২৪৯টি। এগুলোর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নামে জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিতেন পরিবহনের মাফিয়াখ্যাত শাজাহান খান। শাজাহান, এনায়েত ও রাঙ্গার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও অন্তত এক ডজন প্রভাবশালী পরিবহন নেতা। যারা মূলত সিন্ডিকেট পরিচালনায় ওই তিনজনের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। তাদের অনেকে এখন পলাতক। এদের অন্যতম হলেন ওসমান আলী, মুখলেছুর রহমান ও সাদিকুর রহমান হিরু, গাবতলীকেন্দ্রিক মো. আব্বাস, মো. বুলু, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মোহাম্মদ মনির ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই সংগঠনের নেতারা কার্যালয়ে আসেন না। অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তবে সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করে সংগঠনগুলোর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। গত ৫ আগস্টের পর ওই ফেডারেশন ও পরিবহন মালিক সমিতিসহ অধিকাংশ সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে নতুন মুখ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বর্তমান দপ্তর সম্পাদক কাজী মো. জুবায়ের মাসুদ বলেন, ‘পরিবহন-মালিকদের ব্যবসা সংরক্ষণ ও যাত্রীদের স্বার্থে দায়িত্ব নিয়েছি। সমিতি পরিচালনার জন্য ন্যূনতম যে খরচ দরকার, সেটা তোলা হবে। তবে যত্রতত্র চাঁদাবাজি কিংবা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য যাতে চাঁদা না তোলা হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে ও চাঁদাবাজি কমেছে। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গেও একাধিকবার বসেছি।’
এদিকে আওয়ামী সরকারের শাসনামলে কয়েক দফা ভাড়া বাড়ানো হয়। জ্বালানি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে বা সাধারণ যাত্রীদের বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া নৈরাজ্য চালায় পরিবহন খাতের ওই সিন্ডিকেট। আওয়ামী সেই সিন্ডিকেটেরও পতন হয়েছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি। বরং নতুন যারা এই খাতের ‘দখল’ নিয়েছেন তারা অল্প সময়ের মধ্যে ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গত বুধবার রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী ও কলাবাগান টিকিট কাউন্টার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯-১০ সালে ঢাকা-পাবনা রুটে ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ বাসের ভাড়া ছিল ২৬০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে এখন তা ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার চেয়ারকোচ বাসের ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা, যা ২০২২ সালের আগস্টের পর বেড়ে হয়েছে গড়ে ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-বরিশাল রুটের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা এখন বেড়ে ৬০০ টাকা।
টিকিট কাউন্টারগুলোর একাধিক যাত্রী জানান, ‘ভাড়া বাড়ানো একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগী শুধু সাধারণ মানুষ। এসব দেখার কেউ নেই।’ তবে কাউন্টারের একাধিক কর্মী জানান, তেলের দাম বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তারা জানান, এসব পরিবহন-মালিকরাই ভালো বলতে পারবেন।
Sharing is caring!