প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও কমছে না ধর্ষণ

admin
প্রকাশিত
শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও কমছে না ধর্ষণ

প্রজন্ম ডেস্ক:

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার সবচেয়ে জঘন্যতম নির্যাতন ধরা হয় ধর্ষণকে। দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরের পরিস্থিতি আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। সমাজের নানা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। শুনতে হয় নানা কটু কথাও। আর শিশু বা অবিবাহিত নারীরা যখন ধর্ষণের মতো অমানসিক নির্যাতনের শিকার হন তাদের সামাজিক অবস্থা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মৃত্যুদণ্ডের মতো আইন, সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপসহ আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও তা কমেনি। দেশজুড়ে প্রতি মাসেই নারী ও শিশুর প্রতি ঘটছে ধর্ষণের মতো সহিংস অপরাধ।

 

২০১৯ ও ২০২০ সালে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনায় আলোচনায় আসে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে বিদ্যমান আইনের সংশোধন নিয়েও। আইন সংশোধনের জন্য সারাদেশে শুরু হয় আন্দোলন-প্রতিবাদ। দাবি ওঠে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় বর্ণিত—‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’ এই আইন সংশোধনের। ফলে সারাদেশে নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের মুখে ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের পদক্ষেপ নেয় সরকার। নতুন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ এর স্থলে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ এই পরিবর্তন আনা হয়।

আইনের পরিবর্তন হলেও কমেনি ধর্ষণের সংখ্যা। দেশজুড়ে আগের অবস্থাই বিরাজ করছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু। ২০২১ সালে সারাদেশে এক হাজার ২৩৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কন্যাশিশু ৬২৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, যেখানে কন্যাশিশুই ২২ জন। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও সাতজন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৩ জন কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন নারী। ২০২১ সালে হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন।

সংস্থা দুটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে প্রতি বছরই ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালেও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ শতাধিক নারী ও শিশু। নতুন আইনে শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড করা হলেও কমছে না ধর্ষণের সংখ্যা। নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি পরিবারের মধ্যেও যৌন সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নারীরা মনে করেন, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও পরিবারে নিরাপত্তা বিধানে পারিবারিক মূল্যবোধের বিকাশে কাজ করা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তনিমা হোসেন তমা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র নারীদের একটা ভয়-শঙ্কা নিয়েই চলতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে অধিকাংশই দেখা যায়, পরিবারের নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার হয়। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমে দরকার পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন। একই সঙ্গে পারিবারিক মূল্যবোধের বিকাশ না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটা পুরোপুরি সম্ভব নয়।

 

পাশাপাশি বিদ্যমান নতুন আইনে অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করেন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা নারীরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েজ অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোছা. ইসরাত জাহান ইশা বলেন, দেশজুড়ে আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ধর্ষণ কমছে না। এজন্য দরকার অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থানকে তোয়াক্কা না করে আইনের মাধ্যমে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই এর সূত্রপাত। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একইসঙ্গে ধর্ষণ যে শুধু যৌন চাহিদা থেকে হয় তা নয়, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।

 

ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অনেকে বিচার চান না। বিচার না পাওয়া, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, নানা হেনস্তার শিকার হওয়া এর পেছনে বিশেষ কারণ বলে মনে করেন অনেকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর খান বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ফলেই আইন থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচার চাইতে যান না। বিচারে বেশি সময়ও লাগে। বিচারের জন্য একজন নারীকে যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাও বিব্রতকর। ধর্ষণের শিকার কোনো নারী যখন থানায় যান, তারা অধিকাংশই হেনস্তার শিকার হন। তাছাড়া অপরাধীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে ভুক্তভোগীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। সাক্ষী থাকলেও তারা ভয়ে যেতে চান না। ফলে ধর্ষণের সংখ্যা কমার বিপরীতে বরং বাড়ছে।

দুই দশক আগে তৈরি করা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান ছিল ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’। সেই আইনে সবগুলো ঘটনার সঠিক বিচার হলে ধর্ষণ আর বাড়তো না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আইন করে যদি বিচারই না করা হয় তাহলে এসব আইন করে কোনো লাভ নেই। কঠোর আইন করার পরও আইনের প্রয়োগ নেই। এক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু থাকলে মৃত্যুদণ্ডের আগে যখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সাজা ছিল তখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাজা হয়নি। অপরাধীরা আইনের আওতায় আসেনি।

আইনে কাজ না হওয়ার পেছনে একটা গলদ আছে। এর সঙ্গে বেশকিছু কারণও উল্লেখ করেন এই অপরাধবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, আইনানুযায়ী কাজ না হওয়ার পেছনে পুলিশের ভূমিকা, কোর্টের ভূমিকা, সাক্ষীদের আনা, হয়রানি- এই পুরো ব্যবস্থাটার মধ্যে একটা গলদ বা ত্রুটি আছে। এছাড়া সামাজিক কুসংস্কার ও লজ্জায় নারীরা ভিকটিম হলেও প্রকাশ করতে চান না। আবার ভিকটিমকে যখন বারবার ভিকটিমাইজ করা হয় তখন এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তাকে যে টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাও খুবই কঠিন, লজ্জাজনক ও কষ্টদায়ক।

 

আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এক ধরনের গাফিলতি ও বৈষম্য রয়েছে বলে মনে করেন ড. জিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যতিক্রমী কিছু ধর্ষণের ঘটনা যখন পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়, এতে জনমত তৈরি হয়, প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি হয়। আর তখনই বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর হয়। কিন্তু সাধারণভাবে যা হওয়া দরকার তা কিন্তু হয়ই না। তাই পুরো সিস্টেমটা ঢেলে না সাজালে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলেও ধর্ষণ কমবে না।

‘যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় তাদের জন্য আইন বেশি সাপোর্টিভ নয়। ধনী পরিবারের কেউ ভিকটিম হলে সোশ্যাল সিস্টেমের কারণেই রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্রুত আমলে নেয়। আবার বিচারব্যবস্থার মধ্যে স্বাধীনভাবে আইন প্রয়োগের সামর্থ্য এখনো সেভাবে হয়নি। অপরাধী যদি ক্ষমতাধর হয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়, তখন আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুকে তারা প্রভাবিত করতে পারে। আর ভিকটিমদের যে সাহায্য পাওয়া দরকার তারাও সেটা পাচ্ছেন না।’

সংবাদটি শেয়ার করুন।