প্রজন্ম ডেস্ক:
বিশ্ববাজারে প্রতিবছরই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। সম্ভাবনাময় শিল্প হওয়ার পরও এ খাতের প্রত্যাশিত রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। বর্তমানে চামড়াশিল্প থেকে রপ্তানি আয় বছরে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার। অথচ এই রপ্তানি খাত থেকে পাঁচ গুণ বেশি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েক বছর ধরে এই খাতের রপ্তানি একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদন না করতে পারাই এই শিল্পে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ।
রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে চামড়াশিল্প অন্যতম। দুই দশক ধরে এই শিল্প সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠে চামড়াশিল্পে সুদিন ফিরবে কবে?
সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তারা অভিযোগ করে বলেন, পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো নির্মাণ না করেই রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরিত করা হয়েছে। চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি পুরোপুরি ঠিক না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কম দামে বাংলাদেশকে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে। যে কারণে বাড়ছে না এই খাতের রপ্তানি আয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন। জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘চামড়াশিল্পের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’ সমস্যা সমাধানে আশ্বাস দেন অর্থ উপদেষ্টা।
চামড়াশিল্প খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা দূষণমুক্ত উন্নত পরিবেশে চামড়া উৎপাদন না করতে পারা। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্সের অভাব। অন্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা, আন্তর্জাতিক বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সিইটিপির সক্ষমতার অভাব, ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ ঘাটতি ইত্যাদি।
সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জমির ওপর স্থাপন করা হয়েছে পরিকল্পিত চামড়া শিল্পনগরী। চামড়া শিল্পনগরীতে জমি বরাদ্দ পেয়েছিল ১৫৪টি ট্যানারি। তার মধ্যে স্থাপনা আছে ১৪২টির। কিন্তু এখন পর্যন্ত চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। এতগুলো বছরেও কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থায়ী জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরু হয়নি। ফলে বুড়িগঙ্গার পর এখন ধলেশ্বরী নদীও দূষণের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইপিটি) প্রকল্পের ঠিকাদার ছিল চীনের প্রতিষ্ঠান। ওই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। যে কারণে প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো হয়নি। হেমায়েতপুর সিইটিপির তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করা হয়েছে ১৫ হাজার ঘনমিটার। ফলে এখানে সক্ষমতার ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, চীনের যে কোম্পানিকে সিইটিপি স্থাপনে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তাদের এ কাজে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। বিসিক ও বুয়েটের কতিপয় কর্মকর্তা সিন্ডিকেট করে চীনা কোম্পানিকে কাজ দেয়। কিন্তু পুরো কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার চলে যায়। ফলে সিইটিপি স্থাপন পূর্ণাঙ্গভাবে হয়নি।’ আপনারা সরকারের কাছে কী চাচ্ছেন– এ প্রশ্নের উত্তরে শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দাবি হচ্ছে সিইটিপির আধুনিকায়ন করা। এর জন্য আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এটা করলে চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্স হবে। ফলে রপ্তানি আরও বাড়বে।’
চামড়াশিল্পের মালিকরা বলেন, সাভারে যে কয়টি ফ্যাক্টরি আছে তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানও আন্তর্জাতিক মানের সনদ পায়নি। অর্থাৎ লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ থেকে সনদ পায়নি। শাহিন আহমেদ বলেন, ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ না পাওয়ায় বাংলাদেশের চামড়ার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। এ জন্য রপ্তানি আয় প্রত্যাশিতভাবে বাড়ছে না।’
চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চামড়াশিল্পের মান সনদকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা হচ্ছে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি। ২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য।
এই সংস্থার সনদ পাওয়া সবচেয়ে বেশি ২৫৪টি কারখানা রয়েছে ইতালিতে। তারপর ভারতে ২৫১টি ও চীনে ২০৬টি সনদ পাওয়া কারখানা আছে। পাকিস্তানে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া ট্যানারির সংখ্যা ৪৫। আর বাংলাদেশে চামড়া খাতের একটি প্রতিষ্ঠানও এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পায়নি।
বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলারের। এর মধ্যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন বা ১২২ কোটি ডলারের। বিশ্ববাজারে চামড়া রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। মোট বাজারের ৩০ শতাংশ দখল করে আছে দেশটি।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য হচ্ছে রপ্তানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত। বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে তার মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এই খাতের অবদান। আর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে অবদান রাখছে ১ শতাংশের নিচে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চামড়াশিল্পের উন্নয়ন চায় সরকার। তাই এই শিল্পের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রপ্তানির চিত্র
বৈশ্বিক বাজার বড় হলেও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়েনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছিল ১২৩ কোটি ডলারের। তার মধ্যে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১০০ কোটি ডলার। পরের টানা তিন বছর রপ্তানি কমেছে। মাঝে দুই বছর কিছুটা বাড়লে ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি আবার কমেছে। গত অর্থবছরে ১২২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয় ২৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা খুবই নগণ্য হলেও অন্য দেশগুলো পিছিয়ে নেই। ভিয়েতনাম ২০২৩ সালে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। একই অর্থবছরে ভারতের রপ্তানি ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। তার মানে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ১৯ এবং ভারত ৪ গুণ বেশি রপ্তানি করছে।
১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক গেজেটের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার নারায়ণগঞ্জ থেকে চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগে এনেছিল। তবে সেখানে বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। রাস্তার পাশে ও ডোবায় ফেলা হতো কঠিন বর্জ্য।
পরিবেশদূষণ রোধে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প নেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৭৬ কোটি টাকা। পরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ নানা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায়। সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১২ সালে। সেটি নির্মাণের পর পুরোপুরি চালু না করেই ২০১৭ সালে কোরবানির ঠিক আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিল জাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘সিইটিপি সম্পন্ন না করেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরিত করা হয় সাভারে। ফলে ট্যানারির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।’ তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে সাভার চামড়ানগরীতে ৭০ শতাংশ ট্যানারি বন্ধ আছে। যেগুলো চালু আছে তার মধ্যে অনেকগুলোতে অর্ধেক উৎপাদন হয়। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শিল্পনগরীতে অবকাঠামোর যে অবস্থা তা দেখে বায়াররা (ক্রেতা) আমাদের থেকে চামড়া নিতে চান না। শিল্পনগরী কমপ্লায়েন্স না হলে বায়াররা এ দেশে থেকে চামড়া নেবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ কারখানা এখন আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে কম সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
সিইটিপির কাজ পুরোপুরি স্থাপন না করার পেছনে দায়ী কে- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিক বাস্তবায়ন করেছে। এর জন্য অবশ্যই তারা দায়ী বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘সিইটিপি পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপন না করতে পারলে বাংলাদেশ লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাবে না। এই সনদ না পেলে ইউরোপ, আমেরিকার ক্রেতারা আমাদের চামড়া নেবে না।’
Sharing is caring!