প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৫ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে কীটনাশক ব্যবহার, ঘটছে মৃত্যুও

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:৪০ অপরাহ্ণ
ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে কীটনাশক ব্যবহার, ঘটছে মৃত্যুও

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বাসায় তেলাপোকা, ইঁদুর, মাছি আর শীতকালে ছারপোকার উপদ্রপে অতীষ্ট নগরবাসী। কড়া রোদে বালিশ তোষক দেওয়া, নিয়ম করে ঘরবাড়ির জানালা খুলে রেখে বাসায় রোদ ঢুকতে সহায়তা করার মতো বিষয়গুলো এখন কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। ফলে এই কীট থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ওষুধ ছিটানো। আগে ইঁদুর মারার এমন সব কৌশল ছিল— যাতে ওষুধ লাগতো না। আর ওষুধ লাগলেও কোনোভাবেই সেটি বাড়ির সব সদস্যদের হাত না লাগে সেই সতর্কতা মানা হতো। কিন্তু হাল আমলে যে স্প্রে ছড়ানো হয়, সেটা এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই। একমাত্র উপায় বাসায় না থাকা। সেই নিয়মও মানতে না পারার কারণে শ্বাসকষ্ট, চামড়ার রোগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর খবরও আসছে প্রায়ই। চিকিৎসকরা বলছেন, এধরনের ওষুধ কেবল ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে কিনে ব্যবহার করলে— এই ক্ষতি এড়ানো যাবে না। আর যারা এসব ওষুধ বিক্রি করেন তারা বলছেন, যথেষ্ট সাবধান করে দেওয়ার পরেও মানুষ সেগুলো ধর্তব্যে নিতে চায় না।

 

রবিবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ছারপোকা মারার ওষুধের গ্যাসে ঘুমন্ত অবস্থায় দুই কারখানা শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ডিএমপির কামরাঙ্গীরচর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মুছা কামরাঙ্গীরচর কয়লাঘাটে শহিদুল্লাহর বাড়ি ‘সাধন ভিলা’র নিচ তলার একটি কক্ষ থেকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, গত ৩ জানুয়ারি রাতে ওই কারখানায় ছারপোকা মারার বা তাড়ানোর জন্য রুমের বিভিন্ন স্থানে ওষুধ ছিটানো হয়। রাতে দরজা জানালা বন্ধ করে দুই শ্রমিক ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন দুপুর ১টার দিকে শ্রমিক নাঈমের স্বজন রিয়াজ তাকে ডাকাডাকি করে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে অন্যদের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে দেখতে পান— তারা দুই জন তোষকের ওপর শোয়া অবস্থায় পড়ে আছেন। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

 

২০২৩ সালের ঘটনা। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগের পর অসুস্থ হয়ে এক ব্যবসায়ীর দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছিল। ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল। ওই বছরই চট্টগ্রামেও একই ধরনের ঘটনট ঘটনা। ছারপোকার ওষুধ ছিটিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিলেন পোশাককর্মী দুই বোন। পরদিন সকাল থেকেই তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দুপুরে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে এক ঘণ্টার ব্যবধানে তাদের মৃত্যু হয়।

 

বাসায় ‘চায়না তেলাপোকা’, ছারপোকা হলে কী করতে হবে— ফেসবুকজুড়ে সে বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষ দেদারসে কিনছে, শেয়ার করছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের দাবি, তারা ঠিকমতো বুঝিয়ে দেন কোন ওষুধ কত পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ব্যবহারকারী সেটা মানছেন কিনা তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। কী এমন থাকে এসব ওষুধে প্রশ্নে নিয়মিত এ নিয়ে কাজটি করেন এমন একজন কর্মী বলেন, ওষুধটা কী সেটা কোম্পানি থেকে বলে না আমাদের। কিন্তু আমরা যখন এটা দেই তখন বুঝতে পারি ভীষণ ঝাঁঝালো। আমরা মাস্কের ওপর মাফলার বা অন্য কাপড় পেঁচিয়ে তারপর কাজ করি। এবং ২৪ ঘণ্টা ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে সেখানে কাউকে থাকতে না করি, শিশুদের ক্ষেত্রে সেটা অন্তত ৪৮ ঘণ্টা। যদিও বেশিরভাগই সেই নিয়ম মানার বাস্তবতায় থাকেন না। পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের একজন কর্মচারী সাবরিন। কোম্পানির নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, একটাও যেন ছারপোকা না থাকে, যত কড়া ওষুধ পারেন দেন, এসব ক্লায়েন্ট নিজে থেকে বলতে থাকে সবসময়। আমরা অল্প পোকা, তেলাপোকা জাতীয় পোকা তাড়াতে কড়া ওষুধ দিতে চাই না, জোর করে ফিউমিগেশন ট্যাবলেট নিতে চায় ক্রেতারা। কারণ ওটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। এটা এমন একটা গ্যাস তৈরি করে যেটা সহ্য করা যায় না। কিন্তু গাফিলতি দুই পক্ষেরই আছে।

 

ঘরদ্বোর বন্ধ করে দেওয়ায় যে গ্যাসের সৃষ্টি হয়— সেখানে অন্তত ৪৮ ঘণ্টা কারোর ঢোকার কথা না। ৪৮ ঘণ্টা পর ঘরে ঢুকে সব খুলে দিয়ে বাসা পরিষ্কার করতে হবে আগে। বিছানার ভেতরে তোষকে দেওয়া ওষুধগুলো তাড়াতে হবে। যে বালিশে ওষুধ দিয়েছে, সেই ওষুধের কার্যকারিতা শেষ হওয়ার আগে সেটাতে মুখ গুজে ঘুমালে মানুষ বাঁচার কথা না।

 

অ্যালুমেনিয়াম ফসফাইটের কারণে যে জটিলতাগুলো হতে পারে সে বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জার্নাল বলছে, এটি ব্যবহারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে নাক, গলা, ফুসফুসকে আক্রান্ত করার পাশাপাশি কিডনি ও লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অ্যালুমেনিয়াম ফসফাইট থেকে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফসফিন গ্যাস তৈরি হয়। এর ফলে বমি ভাব, পেটে ব্যথা, হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যে ঘরে এই ধরনের ওষুধ ব্যবহার হবে, সেখানে অন্তত ৭২ ঘণ্টা কারোর প্রবেশ করা উচিত নয়।

 

এসব রাসায়নিক চামড়ার ক্ষতি করতে পারে উল্লেখ করে ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন বলেন, ‘এসব প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা জরুরি। যেখানে সেখানে ওষুধ ছিটানো থাকলে বা ওষুধ দেওয়ার পরে প্যাকেট ফেললে সেটা যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। বাসার আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় সতর্ক থাকলে, খাবার উন্মুক্ত না রাখলে তেলাপোকা মাছি জাতীয় জিনিস থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যায়। বাকি যেটুকুর উপদ্রুব হয়, সেটার জন্য ওষুধ যথাযথ জায়গার পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার একদম অনুচিত।’

 

কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিং ও নজরদারি থাকার দরকার উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘পেস্ট কন্ট্রোলে কোনটা ব্যবহার করা যাবে, কোনটা কোন মাত্রায় কারা ব্যবহার করতে পারবে, এর একটা স্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার। যেকোনও বিষাক্ত জিনিস যে কেউ কিনে নিয়ে ব্যবহার করার সুযোগ থাকার কথা নয়। যেগুলো মারাত্মক ক্ষতিকারক সেগুলো অবশ্যই লিস্ট করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তা নাহলে এধরনের নীরব হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে।’

Sharing is caring!