প্রজন্ম ডেস্ক:
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর মাত্র তিন মাস। অথচ এখন পর্যন্ত পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধনের কাজ শেষ করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শুধু তাই নয়, পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়াও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এনসিটিবি বলছে, মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ছাপার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাকি শ্রেণিগুলোর বই ছাপানোর দরপত্র আগামী সপ্তাহে আহ্বান করা হবে। এরপর ১৪ অক্টোবর থেকে দরপত্র উন্মুক্ত করা শুরু হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ হলে চলতি মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে বই ছাপা।
সে হিসেবে বই মুদ্রণকারীরা ছাপানোর জন্য সময় পাবেন ৬০ দিনের মতো। এই সময়ে ৩৬ কোটি বই ছাপানোর কাজ শেষ করা এক বিরাট চ্যলেঞ্জ। কারণ এর আগে ১৮০ দিন সময় পেয়েও বই ছাপার কাজ শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। একাধিক মুদ্রণকারী বলছেন, ‘এই ৬০ দিনে পাঠ্যবই ছাপানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সব বই ছাপার কাজ শেষ করতে হলে ফেব্রুয়ারি মাসের চতুর্থ সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। তাই বছরের শুরুর দিন শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রসঙ্গত, ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বছরের প্রথম দিন ‘বই উৎসব’ করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিত।
পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ হয়নি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা সমালোচনার মুখে বাতিল করা হয় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ২০২৩ সালে প্রণীত নতুন কারিকুলাম। এই শিক্ষাক্রম চালুর মাত্র দুই বছরের মাথায় পুরাতন কারিকুলাম অর্থাৎ ২০১২ সালের কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নতুন এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই পরীক্ষা হবে আগের নিয়মে। পাশাপাশি আগামী শিক্ষাবর্ষে সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে আনা হবে পরিমার্জন ও সংশোধন। নতুন কারিকুলামের কারণে এই বছর নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিভাগ নির্বাচনের সুযোগ পায়নি। তারা আগামী বছর দশম শ্রেণিতে বিভাগ নির্বাচনের সুযোগ পাবে। দুই বছরের জায়গায় এক বছরে তাদের সিলেবাস শেষ করার জন্য সিলেবাসও সংক্ষিপ্ত করা হবে। দশম শ্রেণিতে তাদের পাঠদান করানো হবে পুরাতন কারিকুলামের আলোকে। এ ছাড়া আগামী বছর পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করে পরের বছর অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে তা পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা হবে বলেও জানিয়েছে সরকার।
শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও সংশোধন সম্পন্ন ও সমন্বয় করতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা সংশোধন কাজও শুরু করলে কমিটির তিন সদস্যকে নিয়ে আপত্তি তোলে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের নেতারা। তাদের আপত্তির মুখে ২৮ অক্টোবর এ কমিটি বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি বাতিল করা হলেও সংশোধন ও পরিমার্জন কাজে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
আগামী বছর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই নতুন কারিকুলামে হবে। আর চতুর্থ শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণির বইগুলো হবে ২০১২ সালের কারিকুলামের আলোকে। এই বইগুলো সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ চলছে। এনসিটিবি জানায়, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলামের আলোকে প্রণীত বইগুলোতে কোনো বিতর্ক ছিল না। তাই বইগুলোতে কোনো সংশোধন আনা হচ্ছে না।
পাঠ্যবইয়ে কী ধরনের পরিমার্জন ও সংশোধন হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানান, মূলত আগের ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো বইয়ে নতুন দুয়েকটি গল্প যুক্ত করা হচ্ছে। তবে ইতিহাসভিত্তিক বইগুলোতে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। এতে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে দেয়ালে নানা অধিকার, অন্যায়-অবিচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদে আঁকা অর্থবহ গাফিতি দিয়ে বইয়ের ব্যাক কাভার, ইনার কাভার ও ইনার পেজগুলো অলংকরণ করা হতে পারে। এ ছাড়া জুলাই ও আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেও সময় স্বল্পতার কারণ তা আপাতত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। দ্রুত এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে ভুলত্রুটি হতে পারে বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের বইয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে কাউকে নিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা তথ্যগুলো বাদ দিচ্ছি। সঠিক ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করছি।’
এ প্রসঙ্গে এনসিটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, সংশোধন ও পরিমার্জন কাজ প্রায় শেষ। আর কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
বছরের শুরুর দিনেই বই পেতে অনিশ্চয়তা
বছরের শুরুর দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে বিগত সরকারের আমলে কার্যক্রমের অনেকটাই শেষের দিকে নিয়ে এসেছিল এনসিটিবি। অধিকাংশ শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছিল। কয়েকটি দরপত্র খোলার পর মূল্যায়ন কাজও শেষ হয়েছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর মুদ্রণকারীদের আপত্তির মুখে বাতিল করা হয় বিগত সরকারের আমলের সব দরপত্র। এরপর নতুনভাবে শুরু হয় দরপত্র আহ্বানের কাজ।
এদিকে সব প্রক্রিয়া শেষে আগামী মাসের প্রথম দিন থেকে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু করলেও মুদ্রণকারীরা সময় পাচ্ছেন মাত্র দুই মাস। এনসিটিবি ৪০ দিনে বই ছাপার কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছে। বাকি ২০ দিনে জেলা-উপজেলায় বই পাঠানোর লক্ষ্য তাদের। তবে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মুদ্রণকারীরা। তারা বলছেন, আগে সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর ১৮০ দিন সময় দেওয়া হতো বই ছাপাতে। তখনও বই ছাপতে হিমশিম খেতে হতো। এখন এই কম সময়ে কীভাবে সম্ভব?
এদিকে দ্রুত সময়ে বই ছাপার পাশাপাশি এবার বইয়ের মানও নিশ্চিত করতে চায় সরকার। বইয়ের কাগজ ও প্রিন্টের মানে আর কোনো আপস না করতে ইতোমধ্যে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওপর মহল থেকে।
এদিকে এবার বইয়ের কাগজের ওজন ও উজ্জ্বলতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৭০ গ্রাম থেকে বাড়িয়ে কাগজের ওজন করা হয়েছে ৮০ গ্রাম। আর উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মান তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হচ্ছে একটির বদলে দুটি। তারপরও মান নিয়ে উৎকণ্ঠা কমছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুদ্রণকারী বলেন, ‘কাজ পেলাম আর বই ছাপা শুরু করে দিলামÑ প্রক্রিয়াটা তো এত সহজ নয়। আমাদের কাগজ-কালি কিনতে হয়। কিন্তু এত কম সময়ে পর্যাপ্ত কাগজও পাওয়া সম্ভব নয়। আবার কাজ পাওয়ার পর আমাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। চলমান এই অস্থিরতায় ব্যাংক থেকে তা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঋণ পাওয়াও সময়সাপেক্ষ। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ তুলে দেওয়া দুষ্কর।’
দ্রত বই ছাপাতে বহুপাক্ষিক সভা
আগামী বছরের পাঠ্যবই নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে কাগজের মান, দাম নির্ধারণে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে এনসিটিবিতে অনুষ্ঠিত হয় এক বহুপাক্ষিক সভা। এনসিটিবির চেয়ারম্যান ড. একেএম রিয়াজুল হাসানের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ ম কবিরুল হাসান। বৈঠকে এনসিটিবির কর্মকর্তার ছাড়াও মুদ্রণ শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতি, বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্র জানায়, চলমান এই সংকট মোকাবিলায় এনসিটিবির পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মানসম্মত বই ছাপা নিশ্চিত করার জন্য মুদ্রণকারীদের প্রতি অনুরোধ করা হয় এনসিটিবির পক্ষ থেকে। তবে মুদ্রণকারীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারির আগে কোনোভাবেই বই সরবরাহ করা সম্ভব নয়। কারণ এখনও ৬০ শতাংশ দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। মুদ্রণকারীরা বলেছেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে তারা পর্যায়ক্রমে বই সরবরাহ শুরু করবেন। এক্ষেত্রে যেসব বইয়ের দরপত্র আগে আহ্বান করা হয়েছে সেগুলো আগে সরবরাহ করা হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা বই সরবরাহের কাজ শেষ করবেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৬০ শতাংশ বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী মুদ্রণকারীরা।
এদিকে এবার বইয়ের কাগজ ও প্রকাশনার মানে কোনো আপস করা হবে না বলে সাফ জানিয়েছেন প্রধান অতিথি ড. খ ম কবিরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একটি পরিবর্তিত ধারা শুরু হয়েছে। এই নতুন সময়ে আমরা বইয়ের প্রকাশনার মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। কেউ খারাপ মানের বই সরবরাহ করলে তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। বইয়ের মান তদারকির জন্য এনসিটিবির তদারকি টিমের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই মাঠে সক্রিয় থাকবে।
কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি না করার জন্য পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনকে আহ্বান জানানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির পক্ষ থেকে। অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পর্যাপ্ত কাগজ তাদের উৎপাদন করা আছে। কাগজ নিয়ে এবার কোনো সংকট তৈরি হবে না।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
মুদ্রণ শিল্প সমিতির উপদেষ্টা তোফায়েল খান বলেন, ‘এই দ্রুত সময়ে বই ছাপতে হলে সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে এখনও সেই উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার কিছু মুদ্রণকারীকে বেশি কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য নানা বাধ্যবাধকতা যুক্ত করেছিল। এগুলো বাতিল করে বেশি সংখ্যক মুদ্রণকারীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ তুলে আনা সম্ভব নয়।’
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘বই সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে। কয়েক দিনের মধ্যেই তা শেষ হবে। আর বই ছাপানোর জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে এগোচ্ছে। আমরা আশাবাদী, সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারব।’
Sharing is caring!