এডভোকেট মোঃ আমান উদ্দিন:
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজনৈতিক দল অপরিহার্য । দলের নির্দিষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে নেতা কর্মীরা কাজ করবে। জনগনকে নিয়ে সভা সমাবেশের মাধ্যমে দলীয় দর্শনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। নেতা কর্মী তৈরী করে দলকে জনবান্ধব করবে। এটাই স্বাভাবিক। এরই আলোকে ১৯৪৮ সালের ২৩ শে জুন রোজ গার্ডেনে এ. আর খানের বাসায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৎকালিন সময়ে এ দলের ছায়াতলে পূর্ব পাকিস্থানের অধিকাংশ নেতাকর্মী আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অভাবনীয় সফলতা লাভ করে দলটি। দলে দলে দলীয় আনুগত্য স্বীকার করে মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশীর ভাগই আওয়ামী-মুসলিম লীগের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দলীয় কর্মসূচিতে যোগদান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, পূর্ব পাকিস্তানি জনগনের উপর। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়।
পূর্ব পাকিস্তানি জনগন নিজেদের রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃনা পুঞ্জিভুত হতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতার জন্য । ১৯৬৬ সালে আওয়ামীলীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষনা দিলেন ৬ দফা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন পুর্ন সমর্থন করল ৬ দফাকে। ৬ দফার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনগন ঐক্যবদ্ধ হল। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচন হল। সে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ভুমিধস বিজয় লাভ করলো। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানী জনগনের ওপর ক্ষিপ্ত হল। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বললেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রæদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়–ন।” ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হল। দেশের আপামর জনগন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হলো। মা-বোনেদের সম্ভ্রম হানী ও অত্যাচারের শিকার হতে হলো। দেশ স্বাধীন হলো। লাল সবুজের পতাকা ও ৫৫৫৯৮ বর্গ মাইল নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে উম্মোচিত হল।
ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হলো। বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালিত হবে সে আলোকে একখানা খসড়া সংবিধান পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হলো। পার্লামেন্ট সে সংবিধানকে স্বতস্ফুর্তভাবে সমর্থন ও অনুমোদন দিল। সংবিধানের মূল নীতি ঘোষনা করা হলো যথাক্রমেঃ গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায় বিচারের অর্থে সমাজতন্ত্র এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ। কিন্তু তৎকালীন সরকার এ মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করলো। সরকার থেকে প্রথম পদত্যাগ করলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী, ব্যারিষ্ঠার মঈনুল হোসেন সহ আরও অনেকে। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক গংদের প্ররোচনায় অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত। বাকশালের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হবে। অন্য সকল দল ও মতের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করলেন। মাত্র ৪টি পত্রিকা সরকারের মুখপাত্র হিসাবে পরিচালিত হবে।
বোকা জনগন অবিসংবাদিত নেতার সে ঘোষনা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নৃশংষ হত্যা কান্ড সংঘটিত হলো। বঙ্গবন্ধু স্ব-পরিবারে নিহত হলেন। দাফন করা হলো গোপালগঞ্জের টুঙ্গিঁপাড়ায়। শুনেছি সে সময় তার জানাযায় ইমাম সহ ১৩ জন অংশ গ্রহন করেছিল। এটাই ইতিহাসের বাস্তবতা। সাধারণ জনগন কিন্তু তাহার পক্ষে কোথাও এ নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মিছিল মিটিং করেনি। একমাত্র বঙ্গঁবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কিছু সভা সমাবেশ দেশে হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের চাপে বঙ্গঁবীর দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। নির্বাসনে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয় বসবাস করলেন। পরবর্তীতে বাকশাল গঠন যে ভুল ছিল, নেতা কর্মীরা বুঝতে পারেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারই নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ একিভুত হয়। দল স্ব-মহিমায় ফিরে আসে। ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। বিভিন্ন ম্যায়াদে ক্ষমতাসীন হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর প্রথম ক্ষমতাধীন হলেন খন্দকার মোশতাক। আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী অনেকেই যোগদান করলেন তার মন্ত্রীসভায়। রক্ষিবাহিনীর প্রধান ছিলেন তোফায়েল আহমদ, সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন কে.এম শফিউল্লাহ এবং বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন এ.কে খন্দকার। তাদেরকে সাংবাদিকগণ ১৫ই আগস্ট নিয়ে প্রশ্ন করলে সবার একই উত্তর আমরা পরিস্থিতির শিকার। চাইলে তারা প্রতিবাদ করতে পারতেন। করেননি। এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তি এখনও আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা। কারন সবার অজানা। খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে অভ্যুথান পাল্টা অভ্যুত্থান হলো। শুরু হলো ক্ষমতার রদবদল। জিয়াউর রহমান কে’ বন্দি করা হলো। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ৭ই নভেম্বর তাকে মুক্ত করা হলো। তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান ও চীফ মার্শাল এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ঘোষনা করা হলো। কি কারনে তখনকার বিপ্লবি নেতা কর্নেল তাহেরকে সামরিক ট্রাইবুনালে ফাঁসি দেওয়া হলো? তা কিন্তু আজও জাতি জানতে পারেনি। হ্যা-না ভোট হলো। ভোটে সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে মানুষ জিয়াউর রহমানের হ্যা ভোট জয়যুক্ত হলো।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ১৯ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি) ঘোষনা করলেন। তাঁর নিজস্ব স্বত্ত¡া ও দর্শনকে সাদরে গ্রহন করল এদেশের জনগন। বাংলাদেশে সব দলের কার্যক্রমকে উন্মুক্ত করা হলো। খ্যাতি পেলেন বহুদলীয় রাজনীতির জনক। সেই দর্শনকে এগিয়ে নিতে প্রথম মহাসচিব নির্বাচিত করলেন, ডা: এ.কিউ.এম বদরোদ্দজামান চৌধুরী কে। দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে সাধারন জনগন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি) তে যোগদান করতে শুরু করলো। দল একাধিকবার ক্ষমতাসীন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেননা তৃনমুলে দলের গ্রহনযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোটের সুযোগ হলে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এককভাবে দল ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। স্মরন করিয়ে দিতে চাই মাহি বি: চৌধুরীর কারনে প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডাঃ বিঃ চৌধুরীর মত নেতা এখন প্যাড সর্বস্ব দল ‘বিকল্প ধারার’ সভাপতি। দল নেতা তৈরি করে কিন্তু নেতা দল তৈরি করেন না। এ কারণে দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতার সাথে কেহ বেঈমানী করে সফল হননি। হবেনও না।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী (বি.এন.পি) দল সুষ্ট ভোট হলে এককভাবে যে ক্ষমতাসীন হবে, তা কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদের প্রতিদিনকার অতিকথন থেকে বুঝা যাচ্ছে।
২০ দলীয় ঐক্য জোট এর মধ্যে ২/৩টি বাদে বাকী সবাই প্যাড সর্বস্ব দল। এদেরকে ত্যাগ করা সময়ের দাবী। অধিকাংশরই ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু অহেতুক জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে মিটিং এ বসার সুযোগ পেয়ে নানাবিধ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের সাথে ছবি উঠিয়ে নিজের আয় রোজগারের ক্ষেত্র তৈরি করে। এসব ভুইফোড় দল ও নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মত প্রতিষ্ঠিত ও গণভিত্তি সম্পূর্ণ দলের জন্য লজ্জাস্কর। ঘৃণাভরে এদের প্রত্যাখ্যান করুন। বি.এন.পির অগনিত নেতাকর্মী মামলার আসামী। তারা কি একটি মামলায় আসামী হয়েছে? ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বি.এন.পি এবং বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্থ।
বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর গণভিত্তি আছে। ভুইফোড় সংগঠন গুলো ভোটের হিসাবে ৭-৮%। নির্বাচনের সময় আসন ভাগাভাগি নিয়ে অহেতুক ঝামেলা করে থাকে ভুইফোড় সংগঠন গুলো। প্যাড সর্বস্ব দল ত্যাগ করলে তথা কথিত নেতারা আওয়ামীলীগ অথবা বি.এন.পি তে যোগদান করবে। বিলীন হবেনা শুধু বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী। কেননা তাদের নিজস্ব একটি দর্শন আছে। তাদের অনুসারী প্রতিটি পাড়া মহল্লায় নেতা, কর্মী, সমর্থক আছে। যাহা ভোটের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর। স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী হয়ে গেছে। বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বে এখন আর স্বাধীনতা বিরোধী নেতৃবৃন্দ নেই।
শুধু রাজনৈতিক কারণে কিছু নেতা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে থাকে। এটা তো করবেই। যতই বিরুদ্ধাচারন করবে, ততই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের লাভ। ভুইফোড় দলের সঙ্গ ত্যাগ করে প্রত্যেক এলাকার উজ্জীবিত তরুন ও মেধাবী নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনকালীন সময়ে দলীয় মনোনয়নের আশ্বাস দিলে দল শক্তিশালী হবে। নির্বাচনকালীন মনোনয়ন বোর্ড তাদের মধ্য থেকে উল্লেখ করার মত মেধাবী নেতৃত্বকে মনোনয়ন দিবেন। বোর্ড মনোনয়নের ব্যবস্থা করবেন।
যেমন: অপহরণকৃত নেতা বিশ্বনাথ বালাগঞ্জ ও ওসমানী নগরের অবিসংবাদিত নেতা এম. ইলিয়াছ আলী। তার নির্বাচনী এলাকা বি.এন.পি দুর্গ বলে খ্যাত। কথায় আছে তার পরিবার যাকে সমর্থন দিবে সেই এম.পি. হবে। এম. ইলিয়াছ আলীর মত গুনাবলী সম্পূর্ণ নেতাদের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় প্রভাবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব দেওয়া সময়ের দাবী।
লেখকঃ সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও কলামিষ্ট।
সংবাদটি শেয়ার করুন।