প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

মিঠে কড়া সংলাপ: বিধাতার বিধান থেমে থাকবে না!

admin
প্রকাশিত
মিঠে কড়া সংলাপ: বিধাতার বিধান থেমে থাকবে না!

অতীত থেকেই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে কিছু প্রতিকূল ও স্পর্শকাতর বিষয়ের মোকাবেলা করতে হলেও বর্তমানে তার সঙ্গে নতুন কিছু উপসর্গ যোগ হয়েছে। যেমন- করোনাভাইরাস, দিল্লির দাঙ্গা ইত্যাদি। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তাদের দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলে বা প্রবেশের সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি কারণে সময়ক্ষেপণ করলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি যা বলেছেন তার মমার্থ হল, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে সেদেশের নাগরিকদের আমাদের দেশে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে, তাদের কাছে তা পছন্দনীয় নয়। জানি না, ব্যাপারটা এমন কিনা যে, ‘তোমাদের দেশে প্রবেশ করতে আবার এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন? আমরা তো দেশ থেকে পরীক্ষা করিয়েই আসছি!’

এদিকে দিল্লির দাঙ্গার ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বলা হলেও দেশের মানুষের মধ্যে ঘটনাটির ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। দাঙ্গা সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লির রাস্তাঘাট, ড্রেন, হাইড্রেন্ট ইত্যাদিতে এখনও লাশ পাওয়া যাচ্ছে এবং সেসব দৃশ্যও সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করে চলেছে। আবার প্রচুর মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। আর এতদসংক্রান্ত কারণে আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছে। ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে হিটলার যেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে বিতাড়িত করতে বিজেপি-আরএসএসের ভূমিকাকেও এর সঙ্গে তুলনা করে আমেরিকার টিভি চ্যানেলটি একটি বিশদ সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং সে ভিডিওটিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এ অবস্থায় ভারতের দিল্লির দাঙ্গার বিষয়টি আমরা যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি না কেন, বিষয়টি কিন্তু বাংলাদেশিসহ সারা পৃথিবীর মানুষের মনেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কারণ একবিংশ শতাব্দীর এ সভ্য সমাজেও ধর্মের নামে দিল্লিতে যা ঘটেছে তা সভ্যতা ধ্বংসেরই নামান্তর। বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক নীতি এবং বহু ধর্ম ও জাতীয় কৃষ্টি-কালচার অনুশীলনে অভ্যস্ত একটি জাতিসত্তার কারণে আমরা এ বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছি এবং সরকারও আমাদের সেই মনোভাবই প্রকাশ করেছে। কিন্তু ভারতের সরকার এবং তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি ও আরএসএস এ বিষয়ে যে ভূমিকা পালন করে চলেছে, যেসব কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে, দিল্লিতে তারা যে নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আজ রাস্তাঘাটে মুসলমানদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। নামাজ পড়ার সময় মুসলমানদের পেটানো হচ্ছে, নামাজ পড়ে ফেরার পথে পুলিশ তাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করছে, এমনকি পিলারের সঙ্গে বেঁধে পেটানোর দৃশ্যও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব কারণে দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে অন্যত্র বদলি করা হলেও মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে এরপরও এ ধরনের অপকর্ম করতে দেখা গেছে। বিজেপি-আরএসএস কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা অ্যাকশনে গেছে, খিস্তি খেউর করে মুসলমানদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার স্লোগান দিয়েছে। আর সেসব ঘটনার দৃশ্য ও স্লোগান সামাজিক মাধ্যমে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে! সারা পৃথিবীর মানুষ তা অত্যন্ত খোলামেলাভাবেই প্রত্যক্ষ করেছেন।

এ অবস্থায় ভারতে বসবাসরত ২০ কোটি মুসলমান নিজেদের অসহায় মনে করছেন এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আর তাদের সে আতঙ্কের আগুনে বিজেপি-আরএসএস ঘি ঢেলে চললেও ভারত সরকারকে এ বিষয়ে নির্বিকার বলেই মনে হচ্ছে! বরং ভারতের কিছু উগ্রবাদবিরোধী সংগঠন, উদারপন্থী ব্যক্তি, সম্প্রদায়সহ অসাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠী নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে কথা বলাসহ কিছু কর্তব্যকর্মে অগ্রসর হলেও সরকারি দল কর্তৃক তাদের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বিজেপি এবং আরএসএস নেতারা তাদের কঠোরভাবে আক্রমণ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। কারণ ভারতের সরকারি দল বিজেপি ও আরএসএস কর্তৃক তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে রূপদান করা হয়েছে। আর এজন্য মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ ইত্যাদিতে আগুন দেয়াসহ হত্যা-লুটতরাজ করা হয়েছে।

মোট কথা, ভারতের, বিশেষ করে দিল্লির মুসলমানরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। ভালো মনের কিছু হিন্দু প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব বলয়ে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করলেও দিল্লিসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা যে ভালো আছেন, তেমনটি বলা চলে না। কারণ দিল্লির আগুনের তাপ কিছুটা হলেও ভারতের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। আর বিজেপি সরকারের আমলে মুসলমানরা সেদেশে শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবেন সে ভারসাও আজ মিছে! বস্তুত ভারতের মুসলমানদের ভালো থাকার বিষয়টি এখন একটি বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। আর প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়।

কিন্তু এখানে তার সুযোগ কম। বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির ছিল দাবি করে যেমন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, তেমনি বিনা কারণেই যে দিল্লির মসজিদেও আগুন লাগানো হয়, সেসব কথাও এসে যায়। কিন্তু এতসব কথা না বলাই ভালো। আর এসব বলেও কোনো লাভ নেই। একদিকে ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ এবং বন্ধুরাষ্ট্র, অন্যদিকে দিল্লিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনখারাবির মুহূর্তে বিশ্ব মোড়ল খোদ ট্রাম্প সাহেব সেদেশে উপস্থিত থেকে বলে গেছেন, ‘It is upto India’! তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে ভারত একটি সুপার পাওয়ার, সামরিক শক্তিতে পৃথিবীর চতুর্থতম শক্তি।

সুতরাং ভারতের অভ্যন্তরে তারা ন্যায়-অন্যায় যাই করুক, আমাদের পক্ষে তা বিবেচনায় আনা শোভনীয় নয়। কিন্তু তাই বলে মানবতা, মানবিকতা বলে যেসব কথা আছে, একজন মানুষ হিসেবে সেসব কথা তো আর অস্বীকার করতে পারি না বা পারব না। বিবেকের তাড়নায় তাই এসব নিয়ে কিছু কথা বলতে হল। হয়তো আমার এসব কথার কোনো মূল্য নেই অথবা আছে। তবে এখানে ভারত সরকারেরও বোঝা উচিত যে, বিশ্ববিবেক বলেও একটা কথা আছে।

সুতরাং ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের প্রতি যত বেশি অমানবিক আচরণ করা হবে, বিশ্ববিবেকের কাছে ভারতকে কিন্তু ততটাই দায়বদ্ধ হতে হবে। আর দিনে দিনে তা জমা হলে, কে জানে একদিন হয়তো এ কারণেই তাদের পস্তাতে হবে! আর ভারতের বিজেপি সরকারের ক্ষমতার বিষয়ে বলতে গেলেও বলতে হয়, কে জানে আগামী নির্বাচনেই তাদের ভরাডুবি হয় কিনা!’ কারণ ভারতের সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি তথা জনগণ বর্তমান পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছে না। ধর্মীয় উন্মাদনার একটি গোষ্ঠীকে তারা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেবেন বলে মনে হয় না। সময় ও সুযোগ হলে তারা অবশ্যই গণেশ উল্টে দেবেন।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা, একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসসহ তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা, তাদের রাষ্ট্রহীন করার পাঁয়তারা করা- এসব কাজ নিয়তি সহ্য করবে বলে মনে হয় না। আমরা পার্শ্ববর্তী ভ্রাতৃপ্রতিম ছোট একটি দেশ এ বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য না করলেও সেদিন নিয়তির প্রতিশোধ, বিধাতার বিধান কিন্তু থেমে থাকবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন।