প্রজন্ম ডেস্ক:
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাসে কারাগার থেকে জামিন এবং মামলা থেকে খালাস পাওয়া বন্দির সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৩৭৩ জন। অর্থাৎ আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে বাইরে এসেছেন এসব বন্দি। আর এর ঠিক আগের মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে কারাগার থেকে জামিন ও মামলা থেকে খালাস পাওয়া বন্দিসহ জেল পালানো বন্দি ছিলেন ৩৯ হাজার ৬০৯ জন। এর মধ্যে গত ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগার ভেঙে পালিয়েছেন ৮২৬ জন কয়েদি।
সরকার পরিবর্তনের ঠিক এক মাস আগে-পরে (জুলাই ও আগস্ট) কারাগার থেকে প্রতিদিন গড়ে বের হয়েছেন যথাক্রমে ১ হাজার ২৭৭ জন ও ১ হাজার ৩৬৬ জন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত উল ফরহাদ জানান, এসব কয়েদি ও হাজতিকে আদালতের নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু অপরাধী ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জেল থেকে পালিয়ে গেছে। এসব কারণে কয়েক বছরের মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর কারাগারে উল্লেখ করার মতো কমসংখ্যক বন্দি ছিলেন। এ সময় বন্দি ছিলেন ৪৯ হাজার ৭৫২ জন।
বিভিন্ন সময় মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করেছে- হত্যা, সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অভিযোগে অতীতের সব সরকারই দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকায় কারাগারে সব সরকারের আমলেই হাজতিরা মানবেতর দিন কাটিয়েছেন।
এ বিষয়ে জান্নাত উল ফরহাদ জানান, মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন বলে যে অভিযোগ আছে সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ কারা প্রশাসন সব সময় উন্নত সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। তিনি বলেন, প্রতিদিন আদালতের নির্দেশে কিছু বন্দি কারাগারে ঢুকছেন, আবার কিছু বন্দি জামিন অথবা মামলার চূড়ান্ত রায়ে খালাস পেয়ে চলে যাচ্ছেন। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এ জন্য বন্দির সংখ্যা কখনো প্রায় কাছাকাছি আবার কখনো বেশি হয়। তবে বন্দিদের ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
জানা গেছে, কারাগারগুলোতে গাদাগাদি করে অবস্থান করায় মানবিক অধিকার ক্ষুণ্নের পাশাপাশি বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বন্দিরা। তা ছাড়া কারাগারে কোনো গাইনি চিকিৎসক যেমন নেই, তেমনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারী বন্দিরাও নানা রোগে আক্রান্ত হন।
জানা গেছে, রোগীদের মধ্যে বর্তমানে ৫ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী কয়েদি ক্যানসার আক্রান্ত, প্যারালাইজড পুরুষ রোগী আছেন ৪৫ জন, ৫৯৭ জন পুরুষ ও ৩৪ জন নারী কয়েদি আছেন মানসিক রোগী। তা ছাড়া বৃদ্ধ (৬৫ থেকে ৭০ বছর) কয়েদি আছেন ১ হাজার ৩৫১ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী।
তবে ভিন্ন চিত্রও আছে। যাদের প্রভাব বা ক্ষমতা আছে, অর্থবিত্ত আছে তারা কারাগারেই সুবিধাজনক পরিবেশ পাওয়ার পাশাপাশি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে হাসপাতালের আরামদায়ক পরিবেশে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন- এমন অভিযোগও রয়েছে।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম ৬ ফুট করে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের জায়গা প্রয়োজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক কারা কর্মকর্তা বলেন, পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছু কারাগারে নিয়ম অনুযায়ী করা সম্ভব হয় না। প্রায় সময় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি রাখতে হয় বলে তারা অনেক সময় কারাবিধি মানতে পারেন না।
এদিকে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) পর্যন্ত সারা দেশে মোট বন্দি ছিলেন ৬৪ হাজার ৫১৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬১ হাজার ৯৯০ ও নারী ২ হাজার ৫২৪ জন।
এর আগে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের কারাগারগুলোতে ৪২৮ জন বিদেশি বন্দি ছিলেন। তাদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি ৭৩ জন, বিচারাধীন বন্দি ছিলেন ২০৮ জন। আর মুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন ১৪৭ জন।
বিদেশি বন্দিদের মধ্যে ভারতের ২৪৮ জন, মায়ানমারের ১০৮, পাকিস্তানের ৬, নাইজেরিয়ার ৬, পেরুর ২, চীনের ৬, বতসোয়ানার ১ (মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত), মালয়েশিয়ার ৪, বেলারুশের ১, জর্জিয়ার ১, তানজানিয়ার ১, ক্যামেরুনের ১, মালয়ের ১, শ্রীলঙ্কার ১, বাহামার ১ এবং অ্যাঙ্গোলার ১ জন নাগরিক রয়েছেন। এদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ৭৫ জন, বিচারাধীন হাজতি ২০৮ এবং কারাগার থেকে মুক্তির অপেক্ষায় আছেন ১৪২ জন। তবে নভেম্বরে আরও ৩ জন বিদেশি নাগরিক বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ৬৮টি কারাগারের মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি ও জেলা কারাগার ৫৫টি। গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশের কারাগারগুলোতে মোট বন্দি ছিলেন ৬৩ হাজার ১৪৭ জন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৫৭১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। যাদের ২ হাজার ৪৮৩ জন পুরুষ ও ৮৮ জন নারী। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় আটক ৭৫৩ জন, শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দি ৮৪ ও বিশেষ বন্দি ৩৫ জন। যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে হাজতি ৩১ জন, কয়েদি ১৪ ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪৬ জন। জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনসহ ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগে আটক আসামি ৬০৬ জন। মাদক মামলায় ১৫ হাজার ৩৭৬ জন পুরুষ ও ৬৩৬ জন নারী বন্দি।
আবার ১ নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সারা দেশে মোট বন্দি ছিলেন ৬২ হাজার ৩৭৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫৯ হাজার ৯২৮ ও নারী ২ হাজার ৪৪৮ জন। তাদের মধ্যে বিচারাধীন বন্দি ৪৪ হাজার ৪৫২ জন। কয়েদি ১৭ হাজার ৯২৪ জন। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২ হাজার ৫৭৫ জন। লঘুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদি ৩ হাজার ২৩৩ জন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি ৭ হাজার ৩৮৬ জন, আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ১৭৭, পাঁচ বছরের বেশি বিচারাধীন বন্দি আছেন ৬২১ এবং মাদক মামলায় অভিযুক্ত ১৫ হাজার ৮৭৬ জন।
Sharing is caring!