প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

চলে গেলেন প্রবীণ সাংবাদিক ও শিক্ষক আব্দুর রহিম

admin
প্রকাশিত
চলে গেলেন প্রবীণ সাংবাদিক ও শিক্ষক আব্দুর রহিম

সাঈদ চৌধুরী:

প্রবীণ সাংবাদিক মাষ্টার আব্দুর রহিম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তার স্থায়ী ঠিকানায়। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ‘ন। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাবান লেখক, আদর্শ শিক্ষক ও নিবেদিতপ্রাণ দাঈ ইলাল্লাহ।

সাংবাদিক আব্দুর রহিম বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবে টানা তিন বারের সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার নেতৃত্বে প্রেসক্লাবে অনেক সৃজনশীল কর্মকান্ড সম্পন্ন হয়েছে। গ্রামীন সাংবাদিকতায় তিনি সৃষ্টি করেছেন বিশেষ মাত্রা। আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম চিত্র ফুটে উঠেছে তার লেখায়, প্রতিবেদনে।

সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন চার দশক আগে। গ্রাম-গঞ্জের বহু খবর যার হাতে জাতীয় খবরে পরিনত হয়েছে। গ্রামীন জনপদের খবরের পেছনের খবর জাতীয় দৈনিকে নান্দনিক মাত্রা পেয়েছে বার বার। তার প্রাজ্ঞ হাতের ছোঁয়ায় অনেক জেলা সদরের চেয়েও বিয়ানীবাজার উপজেলার খবর ছিল শীর্ষে। চিরচেনা গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার হয়ে ওঠেছিল বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ হিসেবে।

১৯৮৯ সালে আমি যখন দৈনিক সংগ্রামের সিলেট প্রতিনিধি হই, তার বহু আগেই তিনি বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি। জেলা সদরে আমাকে পেয়ে ভীষন খুশি হয়ে ছিলেন। তারপর সিলেট বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এক সময় সারা দেশকে ৫টি জোনে ভাগ করে সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার দায়িত্ব আমাকে প্রদান করা হয়। তখন সাংবাদিক আব্দুর রহিম আমাকে বহু খবর দিয়েছেন। প্রেরণা যুগিয়েছেন সময়ে সময়ে।

আমরা সিলেট থেকে দৈনিক সংগ্রামের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছি। আমার জোনের প্রায় সকল সংবাদদাতা স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। সবার শীর্ষে ছিলেন বিয়ানীবাজার থেকে সাংবাদিক আব্দুর রহিম।

১৯৯০ সালে ৮ অক্টোবর সিলেট নগরির কুদরত উল্লাহ মার্কেটে সংগ্রামের অফিস উদ্বোধন হল। সংগ্রাম পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান, সম্পাদক আবুল আসাদ, জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল ওয়াদুদ খান ও চীফ একাউন্টেন্ট আব্দুস সাত্তার উপস্থিত ছিলেন। আমাদের আঞ্চলিক সংবাদদাতারাও অংশ নিয়েছিলেন। সাংবাদিক আব্দুর রহিম সেদিন গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক খাবার ও ফলমুল নিয়ে এসেছিলেন।

কিছু দিন পর সংগ্রাম ও সোনার বাংলা কার্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনার আয়োজন করি। সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রধান অতিথি ছিলেন। সাংবাদিক আব্দুর রহিম বিয়ানী বাজর থেকে তার একজন কৃতি শিক্ষার্থী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

১৯৯১ সালে ভয়াবহ বন্যায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি ঢাকায় রিপোর্টের পূর্বে স্থানীয় সংবাদদাতাগন আমাকে বিকেল ৬টার আগে খবর পাঠাতেন। উপজেলার মধ্যে বিয়ানীবাজারের খবর ছিল সবার আগে।

১৯৯৪-৯৫ সালে বরাক ড্যাম নিয়ে আমি যখন সিরিজ প্রতিবেদন করি, তিনি কয়েকবার আমার সাথে জকিগঞ্জ সীনান্তে গিয়েছেন। তখন অনুসন্ধানী সংবাদিকতায় তার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে।

১৯৯৬ সালের ২৬ জুলাই জকিগঞ্জ উপজেলার তেলীখালে বিডিআর কর্তৃক জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। মর্মান্তিক হতাহতের খবর পেয়ে আমি দ্রুত সরেজমিন ছুটে যাই। বিয়ানীবাজার থেকে আব্দুর রহিম ও জাকিগন্জ থেকে ফয়জুর রহমান খছরু কয়েকজন বন্ধু সহ অংশ গ্রহন করেন।

জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নে সীমান্ত ফাঁড়ি লক্ষীবাজার ক্যাম্পের ৩৬ রাইফেলস্ ব্যাটেলিয়নের একদল সীমান্ত রক্ষীর বেপরোয়া গুলি বর্ষণে বহু মানুষ হতাহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল হাফিজ, আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, বশির ও মাহবুব। আহতদের মধ্যে আছদ আলী মেম্বার ও মুছব্বির আলী মেম্বার পরে মারা যান। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এমএ লতিফ চৌধুরী ও বজলুর রহমান চৌধুরী (বজলু মিয়া) এবং ও হারিছ আলী মেম্বার দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

গুরুতর আহতদের মধ্যে আরো ছিলেন আজিজুর রহমান, আব্দুর নুর, আব্দুল কদ্দুছ, আসাদ উদ্দিন, এবাদুর রহমান, খলিলুর রহমান, চুনু মিয়া, ছদরুল হক চৌধুরী, ছাইফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, তুফাজ্জল হোসেন এখই মিয়া, পুতুল মিয়া, বদরুল ইসলাম, মতছিম আলী পাখী মিয়া, মস্তাক আহমদ আব্দুর নূর, মুজাহিদ আলী, রিয়াজ উদ্দিন, রুবেল আহমদ, রেহান উদ্দিন, সফিকুল হক, সাইম উদ্দিন, সামছু হক, হুসন মিয়া প্রমুখ।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পর বিডিআর সদস্যরা বারহাল ইউপি চেয়ারম্যান এমএ লতিফ চৌধুরী সহ ছদরুল হক চৌধুরী, মিজান আলী, মুছব্বির আলী মেম্বার, আছদ আলী মেম্বার, হারিছ আলী মেম্বার ও মতছিম আলী পাখী মিয়া প্রমুখকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরে নিয়ে যায়। এদের সাথে আরো বহু মানুষকে আসামী করে বিডিআর সুবেদার ওয়াজিদ আলী বাদী হয়ে জকিগঞ্জ থানায় মামলা করেন।

দৈনিক জালালাবাদে আমরা লীড নিউজ করি। দুপুরের আগে সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটে জালালাবাদ ফটো কপি করে বিতরণ করা হয়। আমাদের প্রতিবেদনের পর সরকার কিশোরগঞ্জের জেলা জজ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

তেলীখাল হত্যাকান্ডের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মাওলানা ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে একদল ষড়যন্ত্র শুরু করে। আমাদের প্রতিবেদনে ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়। ফলে ঘোলা জলে কেউ মাছ শিকার করতে পারেনি।

দৈনিক সংগামে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী এমএ হকের ছেলে রেয়াজুল হক, জকিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাসুক উদ্দিন আহমদ, চারখাই ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত চৌধুরী (মনু মিয়া), মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান বাবুশ্রী জগদানন্দ পুরকায়স্ত, কাজল শাহ ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছোবহান তাপাদার (রানা মিয়া) সহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য তুলে ধরি।

এছাড়া সাংবাদিক আব্দুর রহিম সহ স্থানীয়দের নিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মধ্যবর্তী জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাটের বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল ক্ষতির কারণ নিয়ে প্রতিবেদন করেছি।

অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে ডুবাই হাওর, ফুলতার হাওর, বালাই হাওর, মজুমদারী হাওর, মৈলাট হাওর সহ বিভিন্ন হাওরে ক্ষতিগ্রস্থ চাষাবাদের চিত্র প্রকাশ করেছি। ছাগলী খাল, তেলীখাল, দাশের খাল, নাপিতের খাল, মন্দির খাল, ময়ই খাল, মাদার খাল, রহিমপুরী খাল, সেনাপতিখাল প্রভুতি এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের বক্তব্য তুলে ধরেছি।

এমন অসংখ্য প্রতিবেদনের স্মৃতিময় ঘটনার সাথে জড়িত সাংবাদিক আব্দুর রহিম কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
মাষ্টার আব্দুর রহিম প্রায় তিন যুগ শিক্ষকতা করেছেন পঞ্চখণ্ড হর গোবিন্দ (পিএইচজি) সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। একজন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যারা আজ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
জীবনব্যাপী ইসলাম প্রচারে নিবেদিত ধীমান আব্দুর রহিম ছিলেন বিয়ানীবাজার জিলালুল কোরআন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বিয়ানীবাজার জামেয়া ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও রেক্টর হিসেবে অত্রাঞ্চলে আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষায় জাগরণ ঘটিয়েছেন।

২০০৯ সাল থেকে সপ্তাহ জুড়ে শিরোনামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ তিনি সম্পাদনা করতেন। এছাড়া বিয়ানীবাজার গনদাবি ফোরামের সভাপতি সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

প্রবীণ লেখক ও শিক্ষক আব্দুর রহিম ছিলেন খাঁটি হৃদয়বান এবং মৃদুভাষী মানুষ। ১ আগস্ট রোববার বিকাল পৌনে ৩টায় চলে গেছেন না ফেরার দেশে, মহান মাবুদের দরবারে। ফতেহপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

মৃত্যুকাল স্ত্রী, ৪ সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মরহুমের বড় ছেলে আবুল কালাম মো: শরিফ ফ্রা্ন্স প্রবাসী। মেঝো ছেলে আবুল আহসান মো: জাবুর ব্যবসার সাথে জড়িত। ছোট ছেলে আবু তাহের মো: তুরাব দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার। একমাত্র মেয়ে বিবাহিত।

মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন এবং আপনজনদের ধৈর্য ধারণের তৌফিক দিন। আমিন।

সংবাদটি শেয়ার করুন।