প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১০ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের এখনো ‘হেলিকপ্টার ট্রমা’, ঘুমাতে দেয় না ‘মিছিল-গুলি’

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১, ২০২৪, ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ
শিশুদের এখনো ‘হেলিকপ্টার ট্রমা’, ঘুমাতে দেয় না ‘মিছিল-গুলি’

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

ঢাকার প্রগতি সরণি সংলগ্ন নদ্দায় থাকে শিশু রাফসান। বয়স ছয়। সাড়ে পাঁচতলা বাসা। তাদের ইউনিটের সামনে খোলা ছাদ। বিমানবন্দর খুব কাছে। একটু শব্দ পেলেই ছাদ বা জানালায় ছুটে যায় প্লেন-হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখতে।

গত ৫ আগস্টের পরের চিত্র উল্টো। হেলিকপ্টারের আওয়াজ হলেই আঁতকে ওঠে সে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। বাবাকে বাইরে যেতে দেয় না। রীতিমতো পা ধরে কান্না করে। বলে, বাইরে গেলে ওরা তোমাকে গুলি করে দেবে।

রাফসানের বাবা আরিফ আহমেদ বেসরকারি চাকরিজীবী। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় অধিকাংশ দিন অফিস করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নদ্দা, বসুন্ধরা এলাকা প্রতিদিন আন্দোলনে উত্তাল ছিল। বাড্ডায় আমার অফিস। আমার ছেলে গুলির মতো শব্দ পেলেই দরজা বন্ধ করে দিতো, এখনো শব্দ হলেই মনে করে গুলি হচ্ছে। আমাকেও বাইরে বের হতে দিতো না। মনে করতো আমাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলবে। আমরা টিভি-পত্রিকায় নিউজ দেখতাম। সেও দেখতো। এটা তার মনস্তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।’

দেড় বছর বয়সী আবরার আওসাফ জাহিনের মানসিক অবস্থা আরও করুণ। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলির ঘটনা ভোলে না সে। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে সে এখনো হেলিকপ্টার দেখলেই বলে, গুয়ি…গুয়ি..।

জাহিনের মা নাদিয়া শারমিন বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন একদিন বিকেলে জাহিনকে নিয়ে ছাদে যাই। হঠাৎ একটি হেলিকপ্টার থেকে চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সেই থেকে আমার বাচ্চাটি ভয় পায়। ভয়ে সে হেলিকপ্টারের নাম কিংবা শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে আমার কাছে লুকাতে চায়। এমনকি টেলিভিশনে হেলিকপ্টার উড়তে দেখলেও ওর চোখেমুখে ভয় কাজ করে।’

 

বাবার সঙ্গে বাইরে বের হয়ে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সাফওয়ান বিন সাইফ। আন্দোলন দমাতে পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি চালায়। বাবার সঙ্গে গলিতে ঢুকে কোনোরকমে নিজেদের রক্ষা করে। সেই থেকে সাইফ পুলিশ দেখলে কিংবা পুলিশের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে। শেষমেশ ট্রমা কাটাতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তার বাবা সাদ বারী।

 

২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে আটতলা ভবনের বারান্দা থেকে মা-বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় চার বছর বয়সী আবদুল আহাদ। ২৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রিয়া গোপ (৬)। বাসায় এসব খবরের আলোচনা শুনে শিশুরা আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। শুরুতে বাচ্চাদের সামনে এসব আলোচনা করলেও পরে বাবা-মা সচেতন হন।

আন্দোলনের সময় রেডজোন খ্যাত মধ্যবাড্ডা এলাকার পাঁচ বছরের শিশু সাজিদের বাবা শফিকুল হাওলাদার বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এ এলাকায় কদিন থেমে থেমে গুলির শব্দ পাওয়া যেত। এর মধ্যে কয়েকটি শিশুর মৃত্যুর খবর এলো। আমরা আলোচনা ও সাবধানতা অবলম্বন না করায় ছেলেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে আমরা ওর সামনে আলোচনা করা এবং নিউজ দেখা বন্ধ করে দেই। এখনো সে পুলিশ দেখলে ভয় পায়। প্রথম প্রথম স্কুলেও যেতে চাইতো না।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা রাজপথের দখল নেয়। মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে কারফিউ, হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ ও রাতের আঁধারে বাসা-বাড়িতে তল্লাশি। এসব ঘটনা বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মনস্তত্ত্বে বড় প্রভাব ফেলে। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে শিশুদের এ অবস্থার কারণে অনেক অভিভাবক এখনো দুশ্চিন্তায়।

 

মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে অস্থিরতা দেখা দিলে, সহিংসতার বিস্তার হলে নানা ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম হয়। এর প্রভাব শিশুদের ওপরও পড়ে, সেটা যেন সবার নজর এড়িয়ে না যায়। এমন সময়ে কীভাবে নিজেদের সন্তানদের সহায়তা করা যায়, তা বোঝাটা বাবা-মায়ের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তারা নিজেরাও ট্রমার মধ্যে থাকেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে হামলা, নির্যাতন ও মামলা শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ তৈরি করেছে। আন্দোলনে জড়িত না হয়েও বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে জেনে অনেক শিশু-শিক্ষার্থীও মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। শিশুরা সরাসরি ঘটনাস্থলে থেকে সহিংসতা দেখেছে, কারও কাছ থেকে ভীতিকর অভিজ্ঞতা জেনেছে, গণমাধ্যম থেকে খবর জেনে সেসব চিত্র কল্পনা করেছে, গুরুতর আঘাত ও মৃত্যুর কথা ভেবেছে। ফলে তাদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, চমকে ওঠা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসহায়ত্ব বোধ করার মতো আচরণিক প্রকাশ দেখা গেছে।

 

রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গত ৪ আগস্ট স্কুলপড়ুয়া নাফিস হাসান সৈকত বাসার নিচে হাঁটছিল। বাসার বারান্দায় ছিলেন তার মা। হঠাৎ তার পাশে একজন মধ্যবয়সী লোকের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান। গুলি লাগার দৃশ্যটি মা-ছেলে দেখে ভীত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সৈকতের মা বলেন, ‘এমনভাবে গুলি এলো এবং একজন লোক পড়ে মারা গেলো তা চিন্তার বাইরে। ঘটনাটি আমার ও ছেলের চোখের সামনে যেন বারবার ভাসছিল। ঘুমের মধ্যে, খেতে গেলে কিংবা একা একা থাকলে ওই গুলি লাগার ঘটনা মনে পড়ে। স্বাভাবিক কাজ করতে পারছিলাম না। একমাস পর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই আমরা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলছি এখন।’

শুধু সৈকত ও তার মা নন, আরও অনেক শিশু-কিশোর এখনো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।

সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কেবিনে মন ভার করে শুয়ে আছে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান (১৭)। সংবাদকর্মী পরিচয় দিতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে, ‘গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার সামনে সারা শরীরে গুলি লাগে ১৬টি। এর মধ্যে বাম চোখেই লেগেছিল তিনটি গুলি। যা গত সাড়ে তিন মাসেও বের করা হয়নি। এরই মধ্যে দুটি অপারেশন হয়েছে, সামনে আরেকটি অপারেশন আছে।’

‘সব সময় মাথার ভেতর ব্যথা করে। ঘুম হয় না। গুলি লাগার পর ভয়ে হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে। শরীরের এই ক্ষত সারছে না কিন্তু মানসিক সমস্যা লেগেই আছে। ভালোভাবে ঘুম, খাওয়া-দাওয়া কিংবা অন্য কাজ করতে পারি না।’ বলছিল রিয়াদ।

আন্দোলনে আহত শিশু-কিশোররা সবাই এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে। ট্রমা এক ধরনের মনোদৈহিক চাপজনিত বিষয়। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াবহ ঘটনার অভিজ্ঞতা যা প্রত্যক্ষদর্শীর মনে চাপের সৃষ্টি করতে পারে কিংবা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। অন্যের ট্রমার গল্প শুনেও আরেকজন ট্রমাটাইজ হতে পারে।

 

 

চিকিৎসকদের মতে, কেউ ট্রমায় ভুগলে আবেগ খুব বেশি উঠা-নামা করবে। মানসিক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। নিজের আন্তঃসম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হয়। ঘুমের ব্যঘাত, শ্বাস নিতে কষ্ট, মস্তিষ্কের পরিবর্তন, ইচ্ছা করলেও নিজেকে ঠিক রেখে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না এমন হতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক ও কিছুক্ষণ পর পর চমকে ওঠার ঘটনাও ঘটে।

 

গুলিবিদ্ধ শিশু-কিশোররা ঘুমের সমস্যা-বিষণ্নতায় ভুগছেন

আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপার স্পেশাল হাসপাতাল একটি গবেষণা চালিয়েছে। ২৬ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। এদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বয়স ১২-৩৩ বছরের মধ্যে। প্রাইমারিতে পড়াশোনা ১৩ জন, মাধ্যমিকে ১০ জন ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করা ২ জন।

 

গবেষণায় দেখা যায়, ৪২ শতাংশ রোগী দুশ্চিন্তাগত, ৫৩ শতাংশের ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতায় ভুগছেন ১১ শতাংশ রোগী এবং ১১ শতাংশ রোগীর খিটখিটে মেজাজ।

 

৮৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যু গুলিতে

দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের সময় ৬৫ জনেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হওয়ার তথ্য দেয় জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ।

৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি নাজাত মাল্লা মজিদ।

বিবৃতিতে নাজাত মাল্লা মজিদ বলেন, সবশেষ যাচাই করা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ’ দমনে ৬৫ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ ও শিশুরা সাম্প্রতিক বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিল। তারা অনেক কিছু অর্জন করেছে কিন্তু এর জন্য তারা বিশাল মূল্যও দিয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিংসতার সব ধরনের ঘটনার পূর্ণ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি রেখেছেন।

দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তথ্য বলছে, নিহত ৬৫ জন শিশুর মধ্যে ০-১০ বছর বয়সী ৫ জন, ১১-১৫ বছর বয়সী ২৩ জন ও ১৬-১৭ বছর বয়সী ৩৭ জন।

 

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ সম্প্রতি জানান, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মোট ১০৫ জন শিশু মারা গেছে।

তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে ১০৫ জন শিশু মারা গেছে। এটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ চূড়ান্ত করেছে, আমরা সেখান থেকে তথ্য নিয়ে এসেছি। শিশু হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স ধরে এ তালিকা করা হয়েছে।

 

শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। হাসপাতালের নথি ও স্বজনদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭৯ শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। স্থাপনা ও যানবাহনে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৯ শিশু-কিশোর। একটি শিশুর মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে।

 

 

আন্দোলনে নিহতদের ভাই-বোন-প্রতিবেশীরাও ট্রমায়

গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টারে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সাফকাত সামির (১১) ও তার চাচা মশিউর রহমান (১৬) বাসার বেডরুমে জানালার পাশে টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিল। এ সময় দুষ্কৃতকারীর একটি গুলি মশিউরের ডান কাঁধ ভেদ করে সামিরের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। সামিরকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর মশিউরকে ১৪টি সেলাই দেন।

 

একই গুলিতে আহত মশিউর বলে, ‘একসঙ্গে আমরা দুজন পড়াশোনা করছিলাম টেবিলে। হঠাৎ একটি গুলি আমার কাঁধে লেগে সামিরের মাথায় ঢুকলে মারা যায় সে। এরপর থেকে আমার ওই টেবিলে পড়াশোনা করতে ভয় লাগে। মনে হয় আবার যদি গুলি এসে আমি মারা যাই!’

 

 

সংবাদ মাধ্যমে খবর দেখছেন বাবা-মা। মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। ফুফাতো ভাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়েছে। সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব মিলিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভয়ানক পরিস্থিতি। খবর এলো পাশের বাসার এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়া একজন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে।

 

বাবা-মায়ের সঙ্গে এসব ঘটনার সাক্ষী স্নিগ্ধা-স্বচ্ছ। এ ঘটনার পর থেকে তারা বাইরে যাওয়ার কথা বলতেও ভয় পায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের বাবা বলেন, জুলাইয়ের ২০-২১ তারিখের দিকে বাসার পাশের গোলাগুলি, মিছিল, হইচই আর ভাঙচুরের ঘটনা এখনো ভুলতে পারেনি দুই ভাই-বোন। মৃত্যুর খবর তাদের আরও বেশি আতঙ্কিত করেছিল। এর পর থেকে তারা বাইরে যাওয়ার কথা বলে না। কোনো ভিড়ের মধ্যে যেতে চায় না। টিভিতে নিউজ দেখতে গেলেও সরিয়ে দিতে বলে। তাদের ট্রমা এখনো কাটেনি।

 

 

 

 

প্রয়োজন ৫০ হাজারের অধিক সাইকোলজিস্ট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিসিপিএসের সাধারণ সম্পাদক ড. মো. শাহানূর হোসেন বলেন, ‘দেশে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। এছাড়া ১২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০০-৬০০ জন সাইকোলজিস্ট আছেন যারা কাজ করছেন, যেখানে প্রয়োজন ৫০ হাজারের অধিক।’

 

 

আতঙ্ক আতঙ্ক বাড়ায়, সাহস সাহস বাড়ায়। অভিভাবকরা আতঙ্কিত হওয়ায় সেটা শিশুদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকদের আতঙ্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে। এই এক মাসে তারা এমন অনেক শব্দ শুনেছে, যেগুলোর সঙ্গে তার নতুন পরিচয় হলো। সে জায়গা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। তাকে তার আগের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে। দীর্ঘসময় আতঙ্ক নিয়ে ঘরে বসে থাকায় শিশুর ভয় বেড়েছে। এখন সময়-সুযোগ হলেই তাদের বাইরের পরিবেশে নিয়ে স্বাভাবিকীকরণ করতে হবে।’

 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রির (বিএপি) আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আব্দুল মোত্তালিব বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ধারণা দিতে একটি অধ্যায় সংযোজনের প্রস্তাব করছি। তাহলে ক্রমবর্ধমান এ সমস্যার কার্যকর সমাধানে আশানুরূপ ফল আসবে। সেটা যে কোনো দুর্যোগের কারণে ঘটা বিষয়ে।

 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কামরুল হাসান বলেন, ‘সুন্দর আগামী গড়ে তুলতে আন্দোলনে আহত ও স্বজনদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কাউন্সেলিং চালাতে হবে।’

 

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর এক্সিকিউটিভ জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে শহীদের পরিবারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহত শিশু যারা আছে তাদেরকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্যও আমাদের ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। শাহবাগে ফাউন্ডেশন স্পেশাল সেলের একটি অফিস আছে সেখানে আহতদের ফরম জমা হচ্ছে। ফরম জমা নেওয়া শেষ হলে আহত শিশুদের মধ্যে বাছাই করে বিশেষভাবে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দেওয়া হবে।’

Sharing is caring!