প্রজন্ম ডেস্ক:
মায়ানমার সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এবার একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মূলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে চিঠি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উদ্দেশ্য- রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্পৃক্ত করা। জাতিসংঘের উদ্যোগেই নিউইয়র্কে হবে মহাসম্মেলন, যাতে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা অংশ নেবেন এবং এই সংকট সমাধানে মায়ানমারকে একযোগে বাধ্য করবেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, চীনের মধ্যস্থতায় মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় উপায়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। গত সাত বছরে তা প্রমাণিত হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো যেভাবে সমর্থন জানিয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে সংকট সমাধানের এই উদ্যোগ কাজে লাগতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার এই উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিতে এবং এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকায় দেখতে রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। রোহিঙ্গাবিষয়ক দূত নিয়োগ পাওয়ার আগে ড. খলিলুর রহমান দীর্ঘদিন জাতিসংঘের বিভিন্ন বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে তার পক্ষে জাতিসংঘ সদর দপ্তরকে জোরালো ভূমিকায় আনতে সহজ হবে।
এ ছাড়া জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরির কাজে ভূমিকা রাখতে পারবেন বিশেষ দূত। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন যারা ড. ইউনূসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইউক্রেন ও প্যালেস্টাইন সংঘাত থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আনতে এ ধরনের উদ্যোগ কাজে দিতে পারে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের ঢাকা সফরকালে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে চিঠি দেন। যাতে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। এই উদ্যোগের আয়োজন করবে জাতিসংঘ, যেন বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা তাতে অংশ নেন। এ ছাড়া এই ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ বিশ্বনেতাদেরও উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানাবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা করছে, আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতেই এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করবে জাতিসংঘ, যা নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে। আর জাতিসংঘের সঙ্গে এই উদ্যোগের সার্বিক প্রস্তুতি নিতে সমন্বয়কের কাজটি করবেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান।
সূত্র আরও জানায়, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা দিন দিন কমে এসেছে। এতে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ করতে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। আবার গত কয়েক মাসে নতুন করে আরও ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে কয়েকবার তলবও করা হয়েছে। কিন্তু দেশটির অভ্যন্তরে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি চলতে থাকায় বিষয়টি তার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বা নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিতে পারেননি দেশটির রাষ্ট্রদূত। এই পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার দেওয়া বক্তব্যে রাখাইনে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘সেফ জোন’ বা নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এ ছাড়া সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ বা সম্মেলনের আয়োজন করতে জাতিসংঘকে আহ্বান জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ভলকার তুর্কের মাধ্যমে মহাসচিবকে চিঠি এবং বিশেষ দূত নিয়োগ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এদিকে নতুন করে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ দেশটিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি, আরসা, কুকি-চিনসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংঘাত চলছে। এই সংঘাতের শিকার হয়ে গত কয়েক মাসে আরও প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর আগে কক্সবাজার এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও দীর্ঘমেয়াদি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় চোরাচালান, মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটেছে। এতে সেখানে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
শুধু তা-ই নয়, রাখাইনে আরও যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে, তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে। কারণ সেখানে সংঘাত চলছে এবং রাখাইন রাজ্য শিগগিরই চরম দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বলেছে, একটি মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যা পশ্চিম রাখাইনকে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। মায়ানমার ও প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে পণ্যপ্রবাহে সীমাবদ্ধতা, বাসিন্দাদের আয়-রোজগারের অভাব, মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহার, খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য হ্রাস এবং প্রয়োজনীয় সেবা ও সামাজিক সুরক্ষার অভাবের মতো একাধিক সম্পর্কযুক্ত সমস্যার কথা বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ইউএনডিপি জানিয়েছে, অত্যন্ত বিপন্ন এই জনসংখ্যা আসন্ন মাসগুলোতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে রাখাইন থেকে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও নতুন করে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালাবে। এই পরিস্থিতে পৌঁছানোর আগেই সমস্যার সমাধান না করলে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখা হবে: বিশেষ দূত খলিলুর রহমান
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আগে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এবার এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা হবে। দেশি-বিদেশি সব সাহায্যদাতা সংস্থাকেও রাখা হবে। বুধবার (২০ নভেম্বর) পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে এ কথা বলেন তিনি।
ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এবার আমরা নতুন করে শুরু করতে চাই। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী দাতা দেশগুলোকে রাখতে চাই। কেননা, তাদের সমর্থন আমাদের দরকার। এ ছাড়া রাখাইনে এখন নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে মায়ানমারের সরকারি বাহিনী, আরাকান আর্মিসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর সংঘর্ষে। এটি একটি বাস্তবতা। বাংলাদেশ থেকে যাতে সব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়, সে লক্ষ্যে আমরা আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী দেশগুলো নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে চাই।’
Sharing is caring!