প্রজন্ম ডেস্ক:
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থাও ঠিক এমন। রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশিরভাগই নির্ধারিত সময় শেষ করে অবসরে চলে গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে রয়ে গেছে এর রেশ এবং থাকবেও বহুকাল। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট আর দুর্নীতির এক বড় উৎস হিসেবে বিনা দরপত্রের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বিবেচনা করা হয়। কাছের লোকদের কাজ দিয়ে সে সম্পর্কে প্রশ্ন না তোলার জন্য দায়মুক্তি আইনও করে ওই সরকার। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সেই আইন অবৈধ ঘোষণা করেছে উচ্চ আদালত। এখন রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কী
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে জানার আগে জানতে হবে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে। সরল বাংলায় রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থাৎ, উদ্যোক্তা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবেন, সেখান থেকে সরকার চাহিদা মাফিক বিদ্যুৎ কিনবে। বিষয়টি অনেকটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার মতো। অর্থাৎ, এক ব্যক্তি নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন। ভাড়াটিয়া সেই বাসা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেন। এখন ভাড়াটিয়া সেই বাসায় থাকুক বা না থাকুক, তিনি প্রতিমাসে ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টি হুবহু তাই। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিক বা না নিক তাকে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে—বিগত চারদলীয় জোট সরকারের পতনের পর দেশে গড়ে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। তখন ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেটাই ছিল রেন্টাল বিদ্যুতের প্রাথমিক উদ্যোগ।
এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় সুবিধা হচ্ছে দ্রুত কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসে। অর্থাৎ, সারা বিশ্বেই বিশেষ বিশেষ সময়ে এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে আর কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া হয় না। ধরা যাক, কোনও শহরে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করা হবে। তখন শহরের বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেলো। তিন বা ছয় মাসের জন্য সেখানে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলো। এরপর আবার সেগুলোকে অবসরে দেওয়া হয়। দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও এর বড় অসুবিধা হচ্ছে, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র ছোট ছোট জেনারেটর বসিয়ে নির্মাণ করা হয়। ফলে এর উৎপাদন দক্ষতা কম। এ কারণে উৎপাদন খরচ অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় বেশি হয়।
এবার আসা যাক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কী— সেই আলোচনায়। ফখরুদ্দিন আহমেদের বিদায়ের পর আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ওই সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র আহ্বানের উদ্যোক্তা নির্বাচন করতে এক বছরের বেশি সময় প্রয়োজন হয়, এজন্য তারা আগের সরকারের করা দরপত্রে পাওয়া দরকে ভিত্তি ধরে বিনা দরপত্রে ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। কুইক বা দ্রুততার সঙ্গে যেহেতু রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়—তাই কেন্দ্রগুলোর নামকরণ করা হয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। একইসঙ্গে কেন্দ্রগুলো যেহেতু বিনা দরপত্রে নির্মাণ করা হচ্ছে—তাই ভবিষ্যতে যাতে কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন না করতে পারে, সেজন্য একটি আইনও প্রণয়ন করে তৎকালীন সরকার। চুক্তি করার ক্ষেত্রে যে দায় তৈরি হয় তা থেকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমস্যা কোথায়
কুইক রেন্টাল অর্থাৎ দরপত্র ছাড়া দ্রুততার সঙ্গে এই কেন্দ্র নির্মাণে স্বচ্ছতা ছিল না বলে অভিযোগ আছে। সরকারি ক্রয় নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকার প্রতিটি ক্রয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা বা পিপিআর-২০০৮ অনুসরণ করবে। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সরকার বা সরকারের পক্ষে কোনও সংস্থার ডাকা দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাই কাজটি পাবেন। এখানে একটি স্বচ্ছতার বিধান রয়েছে। কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক কোনও দরপত্র নেই, তাই চাইলে পছন্দের যে কাউকে ডেকে কাজ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বিগত সরকার সেই সুযোগ গ্রহণও করে। গত ১৫ বছর ধরে যারা বা যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিল তারাই কুইক রেন্টাল, রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পেয়েছে। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, বেশি দামে কাজ দেওয়াসহ যেসব অভিযোগ তোলা যায়— কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তার সবগুলোই পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন।
মালিক ছিলেন কারা
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। সে বছরেই আওয়ামী লীগ সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়।
সরকারের ঘনিষ্ঠ সামিট গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। মেয়াদ বাড়ানোর সময় ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তের কথা বলা হলেও ভিন্ন নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা। ফারুক খানের বড় ভাই আজিজ খান সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান। গ্রুপটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত ১৫ বছরে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। কেবল গত অর্থবছরেই সামিট সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। কেন্দ্র থেকে ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ৬টি কেন্দ্র বাবদ তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্রের ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাক্যাটের ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এর ভাড়া ৮৮৩ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প, ভাড়া বাদ নিয়েছে ৭৮৫ কোটি টাকা।
সপ্তম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি, কেন্দ্রের জন্য কোম্পানিটি ভাড়া নিয়েছে ৬৮০ কোটি টাকা। নবম ডরিন গ্রুপের ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার ভাড়া ৬৫১ কোটি টাকা। ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দশম স্থানে রয়েছে দেশ এনার্জির চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভাড়া বাবদ তারা পেয়েছে ৫১৫ কোটি টাকা। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান।
মধু শেষ, হাড়ি এখন ফাঁকা
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিদিনের উৎপাদন বিবরণী ঘেঁটে দেখা গেছে, সারা দেশে এখন আর সেভাবে রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অস্তিত্ব নেই। তিন বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে এসব কেন্দ্র নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ফলে কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ওই সময়ের পর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিগত সরকারের মধ্যমেয়াদি বেইজ লোড বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ধাপে ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে এসব কেন্দ্র রেখে দেওয়া হয়। সমস্যাটি এখানেই শুরু হয়। সাশ্রয়ী বিদ্যুতের বদলে বেশি দামের বিদ্যুৎ দিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হয়। এখনও রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনও কোনোটিকে ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ অর্থাৎ বিদ্যুৎ নিলেই কেবল অর্থ পাবেন—এমন শর্তে রেখে দেওয়া হয়েছে। যাকে বিগত সরকারের ‘বড় পাপ’ হিসেবেই কেউ কেউ বিবেচনা করেন। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জে পাওয়ারপ্যাকের ১০০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জে ৫৫ মেগাওয়াটের একটি, শাহাজিবাজারে ১৩০ মেগাওয়াটের দুটি, ভোলায় ৩৩ মেগাওয়াটের একটি, আমুনারাতে ৫৫ মেগাওয়াটের কেন্দ্র রয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নামেই ৫৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র রয়েছে। অর্থাৎ, সরকারি কুইক রেন্টাল নামে এখন আর কোনও বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা আনু মুহম্মদ বলেন, এই দায়মুক্তি আরও আগে উঠিয়ে নেওয়া দরকার ছিল। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে। কুইক রেন্টাল তার কেবল একটা অংশ। এই দায়মুক্তি তুলে দেওয়ার ফলে চুক্তির নীতিনির্ধারকদের বিষয়ে এখন তদন্ত করা যাবে। তারা এসব কেন্দ্র অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছেন কিনা, স্বজনপ্রীতি করেছেন কিনা, ঘুষের বিষয়টি আসতে পারে। এমনকি কোনও কোম্পানিকে বাড়তি টাকা দিয়েছে কিনা, সেগুলো প্রমাণ করা গেলে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ পাওয়া গেলো। একইভাবে তিনি বলেন, কুইক রেন্টালের মালিকদের বিরুদ্ধে যদি টাকা বেশি নেওয়া, ঘুষ দিয়ে কাজ আদায়সহ সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো প্রমাণ করা যায়—তাহলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা যাবে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের দুর্নীতিকে ধরার এটি কেবল প্রথম ধাপ বলা চলে। আরও অনেক বড় বড় দুর্নীতি আছে এই খাতে। সেসবও আস্তে আস্তে ধরতে হবে।
Sharing is caring!