প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার আন্দোলন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেকটাই বিপর্যস্ত সময় পার করছে বাংলাদেশ পুলিশ। তার পরও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ অন্তত ৪৩টি সংস্কার প্রস্তাব পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীই গত সপ্তাহে নিজেদের এসব প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনে জমা দিয়েছে।
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক ‘জনমত জরিপ বিজ্ঞপ্তি’ জারি করা হয়। এতে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক মতামতের জন্য সাধারণ নাগরিকদের কাছেও মতামত দেওয়ার আহ্বান জানায় পুলিশ সংস্কার কমিশন। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল। এরই মধ্যে পুলিশ বাহিনীর বাইরেও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে পুলিশ সংস্কার কমিশনে লিখিতভাবে নানা ধরনের প্রস্তাব জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সংস্কার কমিটির সদস্যসচিব ও অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্সপেকশন) মো. জালাল ইউ এ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু স্টেকহোল্ডার, তাই আমাদের প্রত্যাশার বিষয়গুলো পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে জমা দিয়েছি। এর বাইরে আপাতত কিছু বলতে চাই না।’
গত জুলাই-আগস্টের ভয়াবহ পরিস্থিতির পর পুলিশের ভেতরে-বাইরে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংস্কারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক লাঠিয়াল হিসেবে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করার ঘটনায় মারাত্মক ইমেজসংকটে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এমন ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি আর কখনোই হতে হয়নি পুলিশ সদস্যদের। বদনাম ও মানুষের নেতিবাচক ধারণার মুখোমুখি হয়ে অনেক পুলিশ সদস্য চাকরিতে আর যোগ দেননি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ভঙ্গুর পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে পুলিশ যাতে মোটামুটি স্বাধীনভাবে ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই গঠন করা হয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত পুলিশের ওই সংস্কার প্রস্তাবে আরও যে পাঁচটি বিষয়ের কথা জানা গেছে সেগুলো হলো- আইনি কাঠামো সংস্কার, পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, পুলিশের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পুলিশের কল্যাণসংক্রান্ত কার্যক্রম।
আইনি কাঠামো সংস্কার
এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে রয়েছে- সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন করা, পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১ ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি)-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা, বিশেষায়িত ইউনিটের বিধিবিধান প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংশোধন করা, জনপ্রত্যাশা পূরণে যুগোপযোগী ও নতুন আইন/বিধি প্রণয়ন করা এবং ইউজ অব ফোর্স, অ্যারেস্ট অ্যান্ড ডিটেনশন, সার্চ অ্যান্ড সিজারসসহ অন্যান্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পলিসি ডকুমেন্টস প্রস্তুত করা।
পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ
এ প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, পুলিশ সদস্যদের সার্বিক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে অভ্যন্তরীণ তদারকি সুসংহতকরণ, পুলিশের অপেশাদার কর্মকাণ্ড রোধ, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি ও আইনের আলোকে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতের লক্ষ্যে পুলিশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা শাখাকে সুবিন্যস্তকরণ, নারীদের যৌন হয়রানি, জেন্ডার বৈষম্য করাসহ অপেশাদার আচরণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, চাকরিবিধি যাতে যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, আধুনিক দক্ষতামাপক সূচক নির্ণায়নের মাধ্যমে পুলিশের কাজের মূল্যায়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ অন্যতম।
পুলিশের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি
এই প্রস্তাবের আওতায় রয়েছে পুলিশের অপারেশনাল ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বিষয়ে অধিকতর উন্নত মানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, অপরাধ তদন্তে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের (বিশেষ শাখা, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই ইত্যাদি) পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি
এ প্রস্তাবে বৈষম্যহীনভাবে সততা, দক্ষতা তিন যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে (নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, প্রণোদনা ইত্যাদি) স্বচ্ছ, আধুনিক ও যুগোপযোগী করা, বৈষম্য নিরসনে সরকারের সদয় অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের (পুলিশ ও নন-পুলিশ কর্মচারী) অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গাইডিং/পলিসি ডকুমেন্টস প্রস্তুত/সংশোধন করা (নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ, জনবল বৃদ্ধি, পুলিশ সদস্যদের কল্যাণসহ আরও বেশ কিছু বিষয়ের কথা বলা হয়েছে।
পুলিশের কল্যাণসংক্রান্ত কার্যক্রম
এ প্রস্তাবে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দৈনিক ৮ ঘণ্টা সরকারি দায়িত্ব পালন ও নিয়মমাফিক ছুটি প্রাপ্তির বিষয়টি সদয় বিবেচনা করা, পুলিশের ওভারটাইম ডিউটির ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বৃদ্ধি করা, যথাযথ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত সব সদস্যের জন্য ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার নিমিত্তে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ে পুলিশ হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাসহ আরও বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘আইন করে কিছু কাজ হয়তো করা যাবে, কিন্তু পরিপূর্ণ পেশাদার পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। এটা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। যারা ক্ষমতায় থাকে (সরকার) তাদের বিবেচনা করে পুলিশকে পরিচালনা করতে হবে। কেননা সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা পুলিশকে অনেক সময় অন্যায় বা অপেশাদার কাজে নিযুক্ত করে থাকে। এ ক্ষেত্রে যারা অন্যায় আদেশ মান্য করবে না তাদের জন্য চাকরি সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার একশ্রেণির পুলিশ সদস্য লোভের কারণে বা ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে অপকর্ম করে থাকে। সেখানেও কঠোর জবাবদিহি থাকতে হবে। তবে সার্বিক প্রেক্ষাপটে পেশাদার ও স্বাধীন পুলিশ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের।’
Sharing is caring!