প্রজন্ম ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা। সে সময় সর্বত্র সমালোচনার মুখে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এ বাহিনী। আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন এ বাহিনীর অনেক সদস্য। ফলে ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের শিকার হয় পুলিশ বাহিনী, ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয় নজিরবিহীনভাবে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, সরকার পতনের পর সারা দেশে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের।
এ সময় সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের ২২৪টি স্থাপনা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভাঙচুর করা হয় পুলিশের আরও ২৩৬টি স্থাপনা। বেশ কিছু থানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। থানায় হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের পাশাপাশি থানার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়েছে, লুট হয়েছে অস্ত্র। নথিপত্র ও মামলার আলামত পুড়ে যাওয়ায় মামলাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সরকার পতনের পর হামলায় ভেঙে পড়ে থানার সার্বিক কার্যক্রম, সঙ্গে পুলিশের মনোবল। এরপর থেকেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি শুরু হয়। হামলার পরে ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোর কার্যক্রম কিছুদিন বন্ধ থাকে। এরপর স্বল্পপরিসরে কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে থানার কার্যক্রম। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা ‘বিট পুলিশিং’ কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছিল, তারাও নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
অন্যদিকে থানায় হামলার সময় বেশ কয়েকটি থানার গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে পর্যাপ্ত টহল গাড়ি না থাকায় ঘুরে ঘুরে এলাকার আইনশৃঙ্খলা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এখনও রয়েছে গাড়ির স্বল্পতা। এ ছাড়া লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের একটা বড় অংশ এখনও উদ্ধার হয়নি। যেগুলো এখনও রয়েছে সাধারণ মানুষ ও সন্ত্রাসীদের হাতে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধী চক্র। এর অন্যতম উদাহরণ মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প। মোহাম্মদপুর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে এ ক্যাম্পে মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিয়মিত গোলাগুলিতে গত তিন মাসে সাতজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুন, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়েছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি এবং ছিনতাইয়ের কারণে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে যৌথবাহিনীর অভিযানে চলতি মাসে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
শুধু সমতলে নয়, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে পাহাড়েও। সেপ্টেম্বর মাসে দফায় দফায় বাঙালি ও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় জারি করতে হয়েছে ১৪৪ ধারা। এ ছাড়া মাজার, মন্দির, মূর্তি ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে। তবে এগুলো এখন কমে এসেছে। এ অবস্থায় জনআস্থা অর্জনে জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে সরকার।
মোহাম্মদপুরে বেপরোয়া ছিনতাইকারী-ডাকাতরা : রাজধানীতে ছিনতাই-ডাকাতির কথা বলা হলে সবার আগে আসে মোহাম্মদপুরের নাম। শুধু রাতে নয়, দিনদুপুরেই দেশি অস্ত্র নিয়ে রাস্তা, দোকান, বাড়িতে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে এ এলাকায়। দিনের বেলা ব্যস্ত সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহন গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। ছিনতাই-ডাকাতিতে অতিষ্ঠ হয়ে মোহাম্মদপুরবাসী একপর্যায়ে থানা ঘেরাও করে। পরে থানা পুলিশ তাদের অপারগতার কথা স্বীকার করে ছাত্র-জনতার সাহায্য চায়। এর পরপরই মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়। যৌথবাহিনীর অভিযানে শতাধিক ছিনতাইকারী ও ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া শাহবাগ, মতিঝিল, খিলগাঁও, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, রামপুরা, হাজারীবাগ, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, উত্তরা পশ্চিম ও পল্লবী, কারওয়ান বাজার, কামরাঙ্গীরচর, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও রেলস্টেশন ছিনতাই-ডাকাতির অন্যতম হটস্পট। এসব এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগই থানায় অভিযোগ করেন না। আবার অভিযোগ করলেও বেশিরভাগই হয় সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। তবে এসব জিডির তদন্ত হয় না বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারে খুন : সরকার পতনের পরে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দখল ও মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এর ফলে এলাকায় এলাকায় গোলাগুলি ও সংঘর্ষ ঘটছে। এতে আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এর মধ্যে অন্যতম স্পট হচ্ছে জেনেভা ক্যাম্প। গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখানে ভুঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বে লাগাতার সংঘর্ষ ও গোলাগুলি চলছেই। গত তিন মাসে এখানে নিহত হয়েছে ৭ জন। আহত হয়েছে একশর বেশি মানুষ। ইতিমধ্যে বুনিয়া সোহেল গ্রেফতার হলেও গোলাগুলি ও সংঘর্ষ থেমে নেই। মোহাম্মদপুর থানায় গত দুই মাসে ২১টি হত্যা মামলা হয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর পল্লবীর বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আয়েশা নামের এক নারী নিহত হয়েছেন। পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাকছুদের রহমান বলেন, মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক সন্ত্রাসী তার প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আয়েশার মাথায় লাগে। এতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।
তথ্য দিতে অপারগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স : ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে খুনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, আগস্ট মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ২৫ ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ২০৮ জন। এ মাসে ধর্ষণের শিকার হয় ১৫ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় দুই নারীকে। আসকের সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য বলছে, গ্রেফতারের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এ ছাড়া ৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৬ জনের মৃত্যু এবং ৮৫৬ জন আহত হয়েছে। এ সময় ধর্ষণের শিকার ২২ নারীর মধ্যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়। তবে আসক এখনও অক্টোবরের তথ্য প্রকাশ করেনি। এ ছাড়া আসকের তথ্য মতে, আগস্ট মাসে হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪৬ জন সাংবাদিক এবং সেপ্টেম্বরে ৭৪ জন। অক্টোবরের তথ্য এখনও জানায়নি তারা।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪১টি। এ ছাড়া অক্টোবর মাসে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৭টি। আগস্ট মাসের খুনের তথ্য দিতে পারেনি ডিএমপি। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘থানায় গিয়ে যদি কেউ পুলিশি সেবা না পায় তা হলে সহকারী উপকমিশনার, ডিসি অফিসে অভিযোগ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে থানায় যারা সেবা দেবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখতে ও সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পুলিশ। পুলিশের সংস্কার নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। মতামতের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব থাকবে সেখানে।’
এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগরের কাছে চার দিন ধরে গত তিন মাসের সারা দেশে খুনের সংখ্যা জানতে চাওয়া হলেও তিনি তথ্য দেননি। তিনি বলেন, ‘তথ্যটা দেওয়া সম্ভব হলে তো দিয়েই দিতাম ভাই’।
মব জাস্টিস : সরকার পতনের পর ‘মব জাস্টিস’ (দলবদ্ধভাবে জোর করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া) নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। গত তিন মাসে বেশ কিছু মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। আসকের তথ্য মতে, মব জাস্টিসে আগস্ট মাসে ২১ জনের এবং সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) তোফাজ্জেল হোসেন ও একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শামীম আহমেদকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বিশেষ করে দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে ভাত খাইয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাতে চার দিন বয়সি শিশুসন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে দলবদ্ধ পিটুনিতে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ। ২০১৪ সাল থেকে পঙ্গু অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিলেন মাসুদ। এরপর ১ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে শিক্ষার্থীকে ‘র্ধষণের অভিযোগ’ তুলে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা নামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২ অক্টোবর গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে ইউনিয়ন বিএনপির আলোচনা সভা নিয়ে দ্বন্দ্বে ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের বড় ভাই জাইদুল হক শ্যামলকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে।
মব জাস্টিস প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, এটা একটা অবৈধ কাজ এবং আইনের ব্যত্যয়। আমাদের সংস্কৃতিতে এটা আগে দেখিনি। ইদানীং এটা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, যদি বিচারিক প্রক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত এগুলোর প্রতি মানুষের যথেষ্ট আশা-ভরসা থাকত তা হলে হয়তো মানুষ এগুলো (মব জাস্টিস) করতে উৎসাহী হতো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের আস্থা নিশ্চিত করতে না পারায় ঘটনাগুলো ঘটছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা ঠিক করে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে না পারলে এ ধরনের ঘটনা বাড়বে বলে মনে করেন এ সমাজবিজ্ঞানী।
ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার : অভিযোগ রয়েছে ঢালাও মামলা ও গ্রেফতারেরও। যাচাই-বাছাই কিংবা প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওপরের নির্দেশে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া মামলার আসামিরা যাতে জামিনে মুক্তি না পায়, সে কারণে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম খিলগাঁও থানায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাসহ ১৮০ জনের বিরুদ্ধে নিজের ছেলে আহাদুল ইসলামকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মো. বাকেরের করা মামলা। পরে এ মামলা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে এজাহার থেকে জেড আই খান পান্নার নাম বাদ দিতে আবেদন করেন বাদী।
এ ছাড়া গত ৫ আগস্ট সিলেটে দৈনিক বাংলার সিলেট ব্যুরো প্রধান দেবাশীষ দেবু এবং ২০ আগস্ট ময়মনসিংহে কয়েকজন বিএনপি নেতাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা মামলার আসামি করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মানবাধিকারকর্মী, আইন বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, এভাবে ঢালাও মামলা হলে ভিকটিমের পরিবার ন্যায়বিচার পাবেন না। এদিকে রাজনৈতিক দলের নেতারাও ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার না করার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য পাওয়া গেছে।
ঢালাও বদলিতে আইনশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত : এদিকে ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক হারে বদলি হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় নতুন মুখ। নতুন জায়গায় বদলি হওয়ার কারণে জায়গা না চিনতে পারা এবং নতুন পরিবেশের কারণেও আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটেছে বলে মনে করেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ। আবার পুলিশের অনেক কর্মকর্তাকে নতুন কর্মস্থলে বদলির আদেশের পর ‘অবিলম্বে’ যোগ দিতে বলা হলেও অনেকেই যোগ দেননি। এর প্রভাবও পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়।
হযবরল ট্রাফিক ব্যবস্থা : এদিকে ৫ আগস্টের পর পুলিশের কার্যক্রম ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থাও স্থবির হয়ে পড়ে। এ সময় সড়কের হাল ধরেন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হলে কিছুদিন পর রাস্তায় নামে ট্রাফিক পুলিশ। তবে রাস্তায় নামলেও যানজট নিরসনে তাদের কার্যক্রম দেখে হতাশ হয় নগরবাসী। এর মধ্যে ৩০ অক্টোবর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিকভাবে ৪০০ শিক্ষার্থী নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে ৭০০ জনের নিয়োগ হবে।’ এর আগে ঢাকা মহানগরের সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে পুলিশের সঙ্গে কাজ করতে ৩০০ শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করার কথা জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তবে উপদেষ্টাদের এ ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, এটা একটা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত।
যৌথ অভিযান : ৫ আগস্টে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার অনুরোধ করার পরও অস্ত্র জমা না দেওয়ায় পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোস্ট গার্ড ও র্যাবের যৌথ অভিযান শুরু হয়। এরপর থেকে আসামি, ছিনতাইকারী, ডাকাত গ্রেফতার ও অস্ত্র এবং মাদক নিয়ন্ত্রণসহ আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার জন্য নিয়মিত যৌথ অভিযান চলছে। যৌথ অভিযানের মধ্যে অন্যতন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিহারি ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে শতাধিক সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়।
ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর এবং শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় ২০০-এর অধিক অপরাধী, ২০টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুলসংখ্যক গোলাবারুদ ও দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ নেশাজাতদ্রব্য উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া রাজধানীর অন্যান্য এলাকাসহ সারা দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও মাদকসহ আসামি গ্রেফতার করে যৌথবাহিনী।
পুলিশ সংস্কার কমিশন : সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের রদবদল হলেও এ বাহিনীর সেবা নিয়ে জনআকাংখার প্রতিফলন ঘটে না। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশকে আগের খোলস থেকে বের করে আনতে এ বাহিনীতে সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এ পরিকল্পনা থেকেই জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে কমিশনের প্রধান করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। ৩ অক্টোবর থেকে কার্যক্রম শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব মতামত বিবেচনা করে ৯০ দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে হবে। গত ৪ নভেম্বর কমিশনপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান কমিশনপ্রধান সফর রাজ হোসেন।
পুলিশ সংস্কার কমিশন কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞ : সার্বিক বিষয় জানার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই বিপ্লবে পেশাগত দিক থেকে পুলিশ বাহিনী সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা এ পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডসহ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের কর্মদক্ষতার ঘাটতির কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছেই। তিনি বলেন, তারা (পুলিশ বাহিনী) কার্যত অভিযানের কথা বলছে, নতুন উদ্যোগের কথা বলছে, কিন্তু মাঠে সেই ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
জুলাই বিপ্লবে যেসব পুলিশ সদস্য মাঠে কাজ করেছে তারা ঊর্ধ্বতনদের হুকুমে করেছে বলে মনে করেন এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এখন পুলিশ বলছে, এটা ব্যক্তির দায়, বাহিনীর দায় না। এ কারণে পুলিশ সদস্যরা রুট লেভেলে আগের মতো কাজ করছেন না। তারা কোনো বিতর্কে জড়ানোর ভয়ে গা-ছাড়াভাবে কাজ করছেন। এ ছাড়া ঢালাও বদলির কারণে নতুন জায়গায় গিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হচ্ছে না।
Sharing is caring!