প্রজন্ম ডেস্ক:
নির্বাচন কমিশনের অধীনেই থাকছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সেবা। একটি পৃথক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালনা হতে পারে। তবে এনআইডির গুরুত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ওই কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। ভোটার তালিকা ও এনআইডির সংযোগ স্থাপনের স্বার্থে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশন থেকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হবে বলে জানা গেছে।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির উপজাত হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাত ধরে নাগরিকরা প্রথমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পান। দিনে দিনে এনআইডির গুরুত্ব জনগণের কাছে বাড়তে থাকে। বর্তমানে যেকোনও কাজে যুক্ত হওয়াসহ রাষ্ট্রীয় প্রায় সব ধরনের সেবার জন্য এনআইডির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বেড়েছে। ফলে নাগরিকের কাছে ভোটার হওয়ার চেয়ে এনআইডি পাওয়ার বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। যার কারণে বিগত দেড় দশকে জনগণের মধ্যে নির্বাচন বিমুখতা তৈরি হলেও এনআইডি লাভের জন্য ভোটার হওয়ার আগ্রহ বেড়েই চলেছে। জানা গেছে, শুরু থেকে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের চিন্তা করেছিল। তবে, মাঠ পর্যায়ে পৃথক অফিস স্থাপন, জনবল ও আর্থিক বিষয় জড়িত থাকায় এটি তখন খুব একটা এগোয়নি। পরে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি অনুবিভাগের তত্ত্বাবধানে এনআইডির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
এনআইডির মাধ্যমে নাগরিক সেবার পাশাপাশি পরিচয় শনাক্তকরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। যার কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ইসির হাত থেকে এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়ে ইসি ও নাগরিক সমাজ থেকে বিরোধিতা করা হলেও এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের হাতে ন্যস্ত করতে বিগত সরকার একতরফা এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে। শেখ হাসিনার সরকার ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০’ বাতিল করে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩’ প্রণয়ন করে। এরপর ওই বছরই ১৪ নভেম্বর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’-এ সংশোধন করে বাংলাদেশের নাগরিকের পরিচয় নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্ড তৈরি ও প্রদান, ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০২৩’ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যাবলি সুরক্ষা সেবা বিভাগের আওতায় পরিচালিত হওয়ার বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়। তবে ওই সরকারের প্রণীত আইনে শর্ত ছিল—সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আইনটি কার্যকর করবে। শর্তানুসারে গেজেট নোটিফিকেশন জারি না হওয়ার কারণে এটি এখনও ইসির অধীনে রয়েছে।
জানা গেছে, পৃথক অধিদফতর তৈরি করে ২০২৫ সালের মধ্যে এনআইডি ইসির হাত থেকে সুরক্ষা বিভাগে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিগত সরকারের।
এরইমধ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এনআইডি হস্তান্তরের নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সরকার পতনের এক মাসের মাথায় গত ১০ সেপ্টেম্বর ইসি সচিবের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিবকে ডিও লেটার দেওয়া হয়। ওই ডিও লেটারে এনআইডির কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে অভিযোগ করা হয়—ইসির সঙ্গে আলোচনা না করে বিগত সরকার একতরফা ওই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। কমিশনের পক্ষ থেকে এনআইডি সেবা ইসির অধীনে রাখার অনুরোধ করা হয়।
সোমবার (৪ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস ১০টি সংস্কার কমিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে ইসি সংস্কার কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকা সমন্বয় করা হচ্ছে বলে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বলেন, ‘এটা সত্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এনআইডি ইসির অধীনে নয়, সরকারের অধীনে আছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের কমিশনও ১৬/১৭ বছর এ কাজটি করে একটি দক্ষতা অর্জন করেছে। কাজেই এটা তাদের অধীনেই রাখাটাই সমীচীন হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের সেবার মান উন্নত করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে।’ নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির সদস্য হিসেবে বৈঠকে এনআইডি প্রশ্নে তিনি তার অবস্থান তুলে ধরবেন বলে জানান। এ বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি পুরোপুরি ইসির অধীনে হবে এমনটা নয়। ইসির তত্ত্বাবধায়নে আলাদা একটা বডির মাধ্যমে এনআইডি পরিচালিত হতে পারে। ভোটার তালিকা ও এনআইডির মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এনআইডির তথ্যের নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে হবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখার বিপক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস এমনিতেই কম। কাজেই তাদের কাছে এটা রাখতে হবে কেন।’
তিনি জানান, সংস্কার কমিটি এখনও এনআইডির বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেনি। এটা নিয়ে যখন আলোচনা হবে তখন সার্বিক বিষয় ব্যবস্থা করে যৌক্তিক সুপারিশ করা হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে বিস্তারিত জানিয়েছি। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এটা দেখা হচ্ছে। এটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। তবে ইসির হাত ধরে এটা এসেছে, সেহেতু আমরা চাইবো এটি ইসির অধীনেই থাকবে।’
Sharing is caring!