প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২২শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ক ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ৮, ২০২৪, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ক ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল:
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সফরে ঢাকায় এসেছিলেন গত শুক্রবার। ঐ দিন দুপুরে আনোয়ার ইব্রাহিমকে বহনকারী বিমান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। পুরোনো বন্ধু আনোয়ার ইব্রাহিমকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ঐদিন সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশে অবস্থানকালে অধ্যাপক ইউনুস আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। এতে রাজনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-এই তিন মূল ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আসিয়ানে বাংলাদেশের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উত্থাপন করা হয়। কেননা ২০২৫ সালে মালয়েশিয়া আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্বভার নিতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ‘কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ এবং বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার কোম্পানি ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর সমস্যা দ্রুত সমাধান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, ‘আমার পুরোনো বন্ধু এবং বাংলাদেশের পুরোনো বন্ধু আসায় আমি খুবই খুশি’। অন্তর্বর্তী সরকারে ড. ইউনুসের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই প্রথম কোনো দেশের সরকারপ্রধানের বাংলাদেশ সফর। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করেন তারা। এ সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের কর্মীদের দুই দেশের অর্থনীতিতে অবদান গুরুত্বপূর্ণ। টিকিট জটিলতায় মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার শ্রমিককে সব সহায়তা দেওয়া হবে। এই অঞ্চলকে শান্তিপূর্ণ দেখতে আসিয়ানকে আরো কার্যকর করতে চায় মালয়েশিয়া।’ তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে আশাকদ ব্যক্ত করেন। বৈঠকে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি, কর্মসংস্থান তৈরি, ভিসা সহজীকরণ এবং উচ্চশিক্ষা, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে হৃদ্যতামূলক আলাপ-আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার মধ্যে এই বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক নতুন নয়। ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় মালয়েশিয়া। ১৯৯৯ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর ২০০০ সালে প্রথম মালয়েশিয়ায় সরকারি সফরে যান বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক যুগের বেশি সময় পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর দ্বিতীয় বার দেশটি সফর করেন তিনি। এরপর ২০১৩ সালের নভেম্বর সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। প্রায় ১১ বছর পর গত শুক্রবার বাংলাদেশ সফর করে গেলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। তার এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার প্ল্যান্টেশন, শিল্প ও পণ্যবিষয়ক মন্ত্রী দাতুক মাজাহ জুরাইদা বিস্তি কামারুদ্দিন বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে পাম ও অন্যান্য শিল্পে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হন। এ সময় বাণিজ্য ও পাম শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার ও ব্যাবসায়িক খাতের প্রচেষ্টা যেমন বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় যৌথ উদ্যোগ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ এবং মালয়েশিয়ার জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সুবিধা সম্পর্কে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। একই বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক অংশীদার। উভয় দেশের চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে মালয়েশিয়ার অবস্থান নবম। কংলাদেশ তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক, হালকা যন্ত্রপাতি ও চামড়াজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩০৬.৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেছে, একই সময়ে ১,৫৭৬,৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে, অনেকগুলোর কাজ প্রায় শেষের পথে। এখানে মালয়েশিয়া ফার্নিচার, কৃষিপণ্য প্রসেসিংসহ সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় ২৮ হাজারেরও অধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। তাদের মাধ্যমে বিস্তৃত হচ্ছে দুই দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধন। এছাড়া উপযোগী ও অনুকূল পরিবেশ থাকায় প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি বাংলাদেশি মালয়েশিয়া ভ্রমণে আসেন। মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ১৪ লক্ষাধিক। ১৯৭৮ সাল থেকে সে দেশে আমাদের শ্রমিক কাজ করতে যাচ্ছেন। সে বছর প্রথম বাংলাদেশের ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের সঙ্গে জনশক্তি নিয়োগের চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে।

বংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির তালিকায় চতুর্থ দেশ হিসেবে রয়েছে মালয়েশিয়া। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের নয় শতাংশের বেশি শ্রমবাজার। কিন্তু এর পরও এ দেশের শ্রমবাজার নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা টানাপড়েনের ঘটনা ঘটে, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত অনিয়ম, প্রতারণা ও দুর্নীতি বন্ধে উভয় সরকারকে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। মূলত সততা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন আমাদের কর্মীরা। এজন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব কর্মীর কল্যাণে উভয় দেশকে নিবিড়ভাবে কাজ করে যেতে হবে।

প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য, একসময় মালয়েশিয়ার অর্থনেতিক অবস্থা বাংলাদেশের মতো থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হওয়ায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ আসতে থাকে দেশটিতে। এতে দেশটি দ্রুত উন্নতি লাভ করে। ব্যবসা- বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবসম্পদ, অবকাঠামো প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে পরিণত হয় একটি অনুকরণীয় রাষ্ট্রে। মালয়েশিয়ার মতো বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করে আমাদের দেশেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি ফোকাস নির্ধারণ ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে এই উচ্চশিক্ষিত বেকার সমস্যার সমাধান এবং উৎপাদন ও আয়স্তর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।

২০২১ সালে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২.৮৯, ১৫.১৩ ও ২০.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে ছিল যথাক্রমে ৩, ২৪ ও ৮.৫৮ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং পার্থক্যটা কোথায়, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগকারীগণকে আগ্রহী করতে পারছি না এবং বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশেকে বিনিয়োগের জন্য আদর্শ স্থান মনে করছেন না। এটা আমাদের চরম ব্যর্থতা। সুতরাং ১০/১২ বছরকে টার্গেট করে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য মহা পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিনিয়োগ বান্ধবর্ণীতি প্রণয়ন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি। এজন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং অথরিটি (বেপজা) এবং বিভিন্ন জেলার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করা প্রয়োজন। প্রয়োজজন ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, স্পেশাল ইকোনমিক জোনসহ দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করা। এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাতগুলোকে শনাক্ত করে এবং কারখানা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীগণকে আমন্ত্রণ জানানো দরকার। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক টিম প্রয়োজন। বাংলাদেশের কৃষি, তথ্য-প্রযুক্তি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীগণকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে।

মালয়েশিয়া ২০২২ সালে বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকষ্ট করার জন্য প্রায় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কৌশলগত অর্থ বরাদ্দ দেয়। আমাদেরও এই ধরনের দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। একজন সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী যাতে প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও সহায়তা সহজেই পেতে পারেন, এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনাসহ এ খাতে গবেষণার জন্য অর্থ-বরাদ্দও বাড়াতে হবে। মালয়েশিয়ার উন্নতি সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আগমনে আমরা তাই আনন্দিত হই। আমরা আশা করি, দুই দেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে।

• লেখক: অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Sharing is caring!