প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষমতার ভারসাম্যে দ্বিকক্ষ সংসদ!

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ২৭, ২০২৪, ০৭:১২ পূর্বাহ্ণ
ক্ষমতার ভারসাম্যে দ্বিকক্ষ সংসদ!

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। তবে এর মধ্যেই রাজনীতিতে নতুন নির্বাচনী বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশের মধ্যমসারির ও ছোট দলগুলো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার জন্য দেশ এখন প্রস্তুত নয়। বরং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি হলে সংসদে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। সংসদে ভারসাম্য আসবে।

 

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক মহলে এখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু নিয়ে আলোচনা চলছে।

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। এ সরকার রাষ্ট্রকাঠামো, নির্বাচনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের ছয়টি খাত সংস্কারে আলাদা কমিশন করেছে।

 

স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর ধরে দেশে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান থাকলেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবিটি নতুন নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এককক্ষের সংসদ যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে পারেনি, তেমনি বারবার স্বৈরাচারী ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশকে বাম রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর দাবি তোলেন। তার দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ১৮ দফায় এই দাবিটিও রয়েছে। এরপর ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এ ছাড়া বিএনপির ভিশন-২০৩০-এও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ভিত্তিতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়টি রাখা হয়েছে। ৩১ দফার ৬ নম্বর দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়টি স্পষ্ট করে দলটি বলেছে, সংবিধানের এক-কেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণœ রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদে ‘উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে। দলটি আরও বলেছে, বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।

 

বিলুপ্ত করা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছর ডিসেম্বরে জাসদ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি তুলে ধরা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সভায় বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।

 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমাদের যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, সেখানে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে স্পষ্ট বলা আছে। অন্য আরও অনেক দলের সঙ্গে কথা বলেই এ সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু হলে সব দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সে ক্ষেত্রে আনুপাতিক পদ্ধতির আর প্রয়োজন হবে না।’

 

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বা সংসদ কী : বর্তমান বিশ্বে ১৯২ দেশে আইনসভা রয়েছে। তার মধ্যে ১০৫টি দেশে এককক্ষবিশিষ্ট এবং ৮৭টি দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলতে এমন একটি আইনসভাকে বোঝায়, যেখানে দুটি কক্ষ বা সংসদ থাকে। এই দুই কক্ষ সাধারণত একটি নিম্নকক্ষ এবং একটি উচ্চকক্ষ নিয়ে গঠিত। ভারতের সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, যেখানে লোকসভা (নিম্নকক্ষ) এবং রাজ্যসভা (উচ্চকক্ষ) রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস দুই কক্ষবিশিষ্ট হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস (নিম্নকক্ষ) এবং সিনেট (উচ্চকক্ষ)।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে উচ্চকক্ষ থাকলেও সব দেশে গঠনকাঠামো ও কার্যপদ্ধতি এক নয়। কোনো কোনো দেশে উচ্চকক্ষ শুধু প্রথা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে সম্মান দেওয়ার জন্য রাখা হয়। আবার যেখানে গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধ ধারণকারী দেশগুলোয় উচ্চকক্ষ আইনসভা সত্যিকার অর্থে কার্যকর।

 

যেমন ব্রিটেনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা খুবই গৌণ। এখানে প্রথা ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে উচ্চকক্ষ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস হলো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। এটি উচ্চকক্ষ (সিনেট) ও নিম্নকক্ষের (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) সমন্বয়ে গঠিত। অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিরা সিনেটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। আইন তৈরির জন্য কংগ্রেসের এই দুটি কক্ষ এক সঙ্গে কাজ করে। অন্যদিকে প্রথা ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সেখানে উচ্চকক্ষ লর্ডসভা এখনো রাখা হয়েছে, যদিও আইন প্রণয়নে এর ভূমিকা গৌণ।

 

কেমন হতে পারে বাংলাদেশের উচ্চকক্ষ : বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি চালু নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের সদস্য স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচ্চকক্ষের সদস্যসংখ্যা ১৩০-১৫০-এর মধ্যে রাখা যেতে পারে। ছোট জেলাগুলো থেকে একজন, মাঝারি জেলা থেকে দুজন এবং বড় জেলাগুলো থেকে তিনজন করে নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চকক্ষের এই সদস্যরা আসতে পারেন। সে নির্বাচন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুভাবেই হতে পারে। প্রত্যক্ষ হলে জনগণের সরাসরি ভোটে উচ্চকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। তবে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের নির্বাচন একই দিনে একই তফসিলে অনুষ্ঠিত হওয়াটা ঠিক হবে না। মেয়াদকালের ভিন্নতা ও ভিন্ন তফসিলে নির্বাচন হলে একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারবে না।

 

তিনি ওই ধারণাপত্রে লেখেন, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক, উচ্চকক্ষের প্রার্থীর বয়স ও অন্যান্য যোগ্যতা নিম্নকক্ষ থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন হবে। এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের বাইরে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন অত্যন্ত প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ, বিভিন্ন পেশায় সফল ও জাতীয় নানা কার্যক্রমে অবদান রাখা ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করলে রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করবেন।

 

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি অনেক আগেই তোলা হলেও, কেন হলো না, তা ভেবে দেখার বিষয়। অনেক দেশেই দ্বিকক্ষ সংসদ রয়েছে। সেখানে ভিন্নতা রয়েছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতেও উচ্চকক্ষ হতে পারে। তবে সেটা একটু জটিল প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ কেমন হবে, তা রাজনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন হলে জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা ও কাজের ধারার আমূল পরিবর্তন হবে। জাতীয় সংসদ সদস্যদের আর্থিক ও নানা প্রাধিকার পরিবর্তিত হবে। জাতীয় সংসদ সদস্যের সব কাজ হবে জাতীয় সার্থকে বিবেচনায় রেখে, এখানে দলীয় ও ব্যক্তি বিবেচনা আসতে পারবে না এবং সব কাজ হবে সংসদকেন্দ্রিক।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল আলম সেলিম বলেন, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ তৈরি হতে পারে। উচ্চকক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধি থাকতে পারে। নিম্নকক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন হবে। তখন সংসদে একটা ভারসাম্য তৈরি হবে। কোনো দল মেজরিটি নিয়ে সংসদে গেলে ইচ্ছামতো আইন করবে অথবা সিদ্ধান্ত নেবে এটা হবে না।’

Sharing is caring!