প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভারতের সড়ক ব্যবহার করে ৩৬ দেশে পোশাক রফতানি করতো বাংলাদেশ

editor
প্রকাশিত এপ্রিল ১২, ২০২৫, ০৯:২২ পূর্বাহ্ণ
ভারতের সড়ক ব্যবহার করে ৩৬ দেশে পোশাক রফতানি করতো বাংলাদেশ

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ—এই ১৫ মাসে ভারতের সড়ক ব্যবহার করে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩৬টি দেশে রফতানি করেছে প্রায় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার পণ্য। এতে ডলার হিসাবে আয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, প্রতি মাসে গড়ে ৩৭৬ কোটি টাকা রফতানি করতো বাংলাদেশ।

এই পণ্য পরিবহন হয়েছে ট্রাকযোগে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিভিন্ন বন্দর এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে। তবে সম্প্রতি ভারত হঠাৎ করে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে, যার ফলে অনিশ্চয়তায় পড়েছে এই রফতানি কার্যক্রম। শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করলে ঢাকার চেয়ে প্রতি কেজিতে ৫০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত খরচ কম হতো। সেই সঙ্গে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের বুকিং জট এড়ানো যেতো। ফলে ভারত এই সুবিধা বাতিল করায় বিকল্প পথ হারিয়ে পোশাক রফতানিতে নতুন চাপ তৈরি হয়েছে।

 

ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল: সমস্যা ও শঙ্কা

২০২০ সালের ২৯ জুন ভারত ‘ব্যবসা সহজীকরণ’ নীতির আওতায় বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়। এর আওতায় পণ্য বেনাপোল-পেট্রাপোল দিয়ে ভারতের ভূখণ্ড অতিক্রম করে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর কিংবা সমুদ্রবন্দর হয়ে তৃতীয় দেশে যেতো। কিন্তু গত ৯ এপ্রিল ভারতের সিবিআইসি (CBIC) আকস্মিকভাবে ওই সুবিধা বাতিল করে।

ফলে একইদিন বেনাপোলে আটকে যায় তৈরি পোশাক খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের চারটি ট্রাকভর্তি রফতানিযোগ্য পণ্য। এসব পণ্য স্পেনে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস ট্রাকগুলোকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ায় তা ফেরত নিতে হয়।

 

Manual6 Ad Code

পরিসংখ্যান যা বলছে

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৯০৯ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং মার্কিন ডলারে ৪৬২ মিলিয়ন ডলার।

এই তথ্যটি বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক পণ্যের ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রফতানির (ট্রান্সশিপমেন্ট) চিত্র তুলে ধরেছে। এই রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে সড়কপথে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের পেট্রাপোল হয়ে বিভিন্ন দেশের গন্তব্যে পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানোর সুযোগ দেয়। বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা ব্যবহার করে প্রায় ৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। এর মধ্যে ৬০৬টি প্রতিষ্ঠান পোশাক খাতভুক্ত।

Manual7 Ad Code

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, গত বছর কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৪৪ হাজার টনের পণ্য রফতানি হয়েছে। এখন এই পুরো চাপ শাহজালাল বিমানবন্দরে পড়বে, যার জন্য বাড়তি প্রায় ৭৩০টি ফ্লাইট প্রয়োজন হবে। এতে ইউরোপ-আমেরিকার রুটে পরিবহন খরচ ও জট দুই-ই বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, স্পেন ছিল সবচেয়ে বেশি চালানপ্রাপক দেশ, যেখানে পোশাক গেছে কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে। ভারত সুবিধা বন্ধ করার আগে সোমবারও ১১টি চালান গেছে কলকাতায়। কিন্তু বুধবার থেকে এই রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং কিছু ট্রাক ফেরত পাঠানো হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ঢাকা বিমানবন্দরকে আরও কার্যকর করতে হবে এবং বিকল্প আন্তর্জাতিক রুট খোঁজার দিকেও নজর দিতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখন বড় এক পরীক্ষার মুখে। ভারত হয়ে রফতানির বিকল্প পথ যদি কার্যকর না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দ্রুত কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং বিকল্প রফতানি রুট খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সুবিধা পুনর্বহালের চেষ্টাও চালানো উচিত।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হতাশাজনক। এই পথটি আমাদের জন্য বিকল্প ও খরচ সাশ্রয়ী ছিল। এখন তা বন্ধ হওয়ায় রফতানিতে বিলম্ব ও খরচ বাড়বে।”

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, “ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হলে কিছুটা চাপ বাড়বে। তবে আমরা নতুন পথ খুঁজছি, যেমন- মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ বাড়ানো।”

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এ ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক বাণিজ্যিক আস্থার জন্য নেতিবাচক। বাংলাদেশের উচিত বিকল্প রুট ও কাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো।

 

সরকার যা বলছে

ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশের জন্য সড়কপথে পণ্য রফতানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলেও এতে বড় কোনও সমস্যা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে দ্রুত এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠবো।’

বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

উপদেষ্টা জানান, বুধবার বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা এখনই না জানালেও তিনি বলেন, ‘যেসব বাধা রয়েছে, তা কাঠামোগত ও খরচ সংক্রান্ত। এগুলো সমন্বয় করে সক্ষমতা বাড়ানো হবে।’

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪০-৫০ হাজার টন পণ্য সড়কপথে ভারতের দিল্লি ও কলকাতা হয়ে বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো বলে জানান তিনি।

Manual2 Ad Code

সরকারি পর্যায়ে ভারতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও চিঠি দেওয়া হবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত এমন কিছু ভাবা হচ্ছে না।

ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে যেসব পণ্য রফতানি হতো

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি, বিশেষ করে নারীদের ব্লাউজ, ব্রিফস, প্যান্টি, স্কার্ট, প্যান্ট, কোট, জামাকাপড়সহ নানা ধরনের পণ্য ভারত হয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছাচ্ছিল।

রফতানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে কটন, স্নিগ্ধতর টেক্সটাইল এবং স্যানিটারি ফাইবারের তৈরি পোশাকের একটি বিস্তৃত পরিসর। বিশেষ করে, নারীদের ও পুরুষদের পোশাকের পাশাপাশি, শিশুদের পোশাক, ট্র্যাকস্যুট, স্নিগ্ধতর পোশাক এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক।

 

রফতানির গন্তব্য দেশগুলো

বাংলাদেশের এই পোশাক রফতানির গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, চিলি, চীন, কলম্বিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, নেপাল, ফিলিপাইনস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।

 

ট্রান্সশিপমেন্ট: রফতানি খাতে ছিল নতুন সম্ভাবনা

এতদিন বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করেছে।

ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা দিতে ২০২০ সালের ২৯ জুন আদেশ জারি করেছিল ভারত। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) গত মঙ্গলবার সেই আদেশ বাতিল করে।

উল্লেখ্য, ট্রান্সশিপমেন্ট পদ্ধতি হলো যখন কোনও দেশের পণ্য অন্য একটি দেশের বন্দরে পৌঁছানোর পর পরবর্তী গন্তব্যে পাঠানো হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক দ্রুত এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাচ্ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সাশ্রয়ী খরচে পণ্য রফতানি করতে পারছিলেন এবং পোশাক রফতানি খাত আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। এই রফতানি কার্যক্রম বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ভারতের বন্দরের মাধ্যমে দ্রুত পণ্য পরিবহন বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code