প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মন্ত্রী-আমলাদের দাপটে অপচয়ের যত প্রকল্প

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ২৩, ২০২৪, ০৩:২৯ অপরাহ্ণ
মন্ত্রী-আমলাদের দাপটে অপচয়ের যত প্রকল্প

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

কথায় আছে- লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। অনেকটা সেভাবেই আওয়ামী লীগ আমলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের অনেকেই বিভিন্ন প্রকল্পের নামে সরকারি টাকার যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছেন। অনেকেই এসব করেছেন এলাকার মানুষের কাছে জনদরদি বা সমাজসেবীর তকমা লাগাতে। কেউ আবার উচ্চ দামে নিজের জমি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে কিংবা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে নিয়েছেন ‘সুবিধাজনক’ এসব সরকারি প্রকল্প। বাদ যাননি সংসদ সদস্যরাও। প্রকল্পে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশুমার লুটপাট চালিয়েছেন তারা। আমলারাও তাদের বাবা-মায়ের নামে এলাকায় হাসপাতাল, ট্রাস্ট ইত্যাদি বানিয়েছেন সরকারি টাকায়। এভাবে ১৫ বছরে নেওয়া অনেক প্রকল্প এখন সরকারের বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তত ১৪ জন মন্ত্রী-এমপির প্রকল্প-বিলাসের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকেই নিজ এলাকায় প্রকল্প নিয়েছেন। তবে সব প্রকল্পকে ঢালাওভাবে অপচয়ের প্রকল্প বলা ঠিক হবে না। কিছু প্রকল্প জনবান্ধবও ছিল। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যেগুলোর কাজ মাঝপথে রয়েছে বা কিছু অর্থ ব্যয় হয়েছেÑ এমন প্রকল্প একটি পর্যায়ে পৌঁছার পর বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

 

উদাহরণ দিতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘ধরুন কোনো প্রকল্পের আওতায় ২০টি সেতু নির্মাণ করা হবে। এখন ১০টির চাহিদা রয়েছে, বাকিগুলোর এখনও নেই। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেগুলো নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এখন ১০টি সেতু নির্মাণ করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে। কোথাও দুই লেনের সড়ক হলেই হয়, কিন্তু প্রকল্পের আওতায় চার লেন করা হচ্ছে। এমন প্রকল্পেও দুই লেনের কাজ শেষ করে প্রকল্প সমাপ্ত করা হবে। যেহেতু অর্থ ব্যয় হয়েছে কাজ শেষ না করে বন্ধ করে দিলে তো অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি জনদুর্ভোগও তৈরি হবে।’

 

 

এলাকায় বেশি প্রকল্প নিতেন পরিকল্পনামন্ত্রীরা

 

নিজের এলাকায় প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জানা গেছে, দেশের কয়েকটি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল আইসিটি বিভাগ। প্রকল্পের ডিপিপিতে তখনও কুমিল্লা জেলার নাম ছিল না। পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে আ হ ম মুস্তফা কামাল শর্ত জুড়ে দেন কুমিল্লা জেলাকে প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেই কেবল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে। পরে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করে কুমিল্লা জেলার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরই প্রকল্পের অনুমোদন দেন সাবেক এ মন্ত্রী। তিনটি প্রকল্পের আওতায় এসব ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২ হাজার ৪৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রকল্পগুলোর আওতায় যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তার বেশিরভাগই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম না চলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ভবন নির্মাণেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি (মুস্তফা কামাল) সব সময় প্রকল্পের মধ্যে নিজ জেলা আছে কি না সেটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন। ক্ষমতা ব্যবহার করে কুমিল্লার জন্য অনেক প্রকল্প বাগিয়ে নেন তিনি।

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের ইচ্ছায় ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হয়। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ২০১০ সালে প্রকল্প নেওয়ার আগে এই পথে কী পরিমাণ যাত্রী হতে পারে, তার কোনো সমীক্ষা হয়নি। বর্তমানে এই লাইন দিয়ে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন চলে। পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ১০টি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত আটটি স্টেশনই বন্ধ ছিল।

ওই প্রকল্পে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকল্পটি নেওয়া হয় তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের ইচ্ছায়। এটি মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকাকে যুক্ত করেছে। তখন সরকারের রাজস্ব খাত থেকে নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল এটি। এর বরাদ্দও দেওয়া হয় দ্রুততার সঙ্গে। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের একধরনের বোঝাপড়া হয়। একই সময় আবুল হোসেনের আগ্রহ ছিল চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনার বিষয়ে। সমঝোতা হয়, এ বিষয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় প্রকল্প নেবে, অনুমোদন দেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টেকনোক্র্যাট কোটায় প্রতিমন্ত্রী হন শামসুল আলম। দায়িত্ব পান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের। আমলা থেকে প্রতিমন্ত্রী হয়ে চাঁদপুরের মতলবে নিজের এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করেন তিনি। ভোটারদের কাছে টানতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও মতলবের মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্প নেন তিনি। ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি নেওয়ার সময়ে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে সঠিকভাবে করা হয়নি মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকও। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সচিবরা প্রকল্পটি না নেওয়ার অনুরোধ করলেও তাদের কথায় কান না দিয়ে এটি একনেকে তোলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সরকারে থেকেও সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করতেন তিনি। অনেকে বলে থাকেন আওয়ামী লীগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে রাতের ভোট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মান্নানের আসনে স্বচ্ছ ভোট হয়েছিল।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এম এ মান্নানও দায়িত্ব পালনকালে নিজের নির্বাচনী এলাকার জন্য অনেকগুলো সরকারি প্রকল্প অনুমোদন করেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুনামগঞ্জে ১০৮টি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ছিল। এম এ মান্নান নিজ এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। নির্বাচনী এলাকায় রাস্তাঘাট-মসজিদ-মন্দির-মাদ্রাসার উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতালের আসন বৃদ্ধি, দুই উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, দুই উপজেলা সড়কে দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, অধিকাংশ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন। প্রকল্পের সংখ্যা বেশি হলেও অধিকাংশ প্রকল্প ছিল জনমুখী। তবে এক এলাকায় এত প্রকল্প নেওয়ার কারণে অন্যান্য এলাকার মানুষ বঞ্চিত হয়েছেনÑ এমন উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন অনেকেই। কিছু প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

 

ব্যক্তিস্বার্থে প্রকল্প বাগিয়ে নেন তারা

 

সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় ‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লী, জামালপুর (প্রথম পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেন। প্রকল্পটির ৭৭২ কোটি টাকা বিফলে যাবে বলে মত দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন।

সাবেক পররাষ্ট্র ও তথ‍্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তার নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় ‘চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেন। ৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার প্রকল্পটির ৭০ শতাংশ পাহাড় ও ৩০ শতাংশ জলাধার হওয়ায় বিভিন্ন সংস্থার আপত্তিতে এটি প্রথমে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই আবাসন প্রকল্পের ছাড়পত্র বাতিল করা হয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ গ্রামে মায়ের নামে হাসপাতাল করতে ৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প নেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’।

সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক করার মহাপরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ব‍্যয়ের প্রকল্পও নেওয়া হয়। বন কেটে এই সাফারি পার্ক তৈরি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। প্রকল্পের নানা খাতের অস্বাভাবিক ব‍্যয় প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু শাহাব উদ্দিনের দাপটের কাছে হার মেনেছিল সব আপত্তি।

ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রকল্প নিয়েছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও। ২০১৬ সালের আইসিটি বিভাগ ‘ই-জুডিসিয়ারি পাইলট প্রকল্প’ নামে ৩২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয়। প্রকল্পটি একনেক সভা থেকে ফেরত পাঠানো হয়। পরে প্রকল্পে নামমাত্র কিছু পরিবর্তন এনে দুই দফায় ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা করা হয়। যদিও সরকার পতনের কারণে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে এ প্রকল্পে পেপার হেয়ারিং রাখার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি মামলার জট কমানোর জন্য নেওয়া হলেও এটি বাস্তবায়ন হলে জট আরও বাড়াবে। প্রকল্পটি শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনুমোদন করাতে চেয়েছিলেন পলক। এটি অনুমোদন পেলে নিজের ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতেন তিনি।

 

মন্ত্রী হলেই নিজ এলাকায় ট্রেন নিতে হবে

 

রেল মন্ত্রণালয়ের একটি প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছেÑ মন্ত্রী হলেই নিজ এলাকায় ট্রেন নিতে হবে। রেলের কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হয়েই সিলেটের পথে কালনী এক্সপ্রেস চালু করেন। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরাসহ পর্যাপ্ত বগি নিয়ে ট্রেনটি চলেছে। মুজিবুল হক রেলমন্ত্রী হওয়ার পর ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে খুব একটা অগ্রগতি করতে না পারলেও তিনি ঢাকা-নেত্রকোণা পথে দুটি নতুন ট্রেন চালু করেন। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন পাঁচটি নতুন ট্রেন চালু করেন। মন্ত্রীর নিজ জেলার জন্য চালু হয় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। এ ছাড়া যেসব ট্রেন দিনাজপুর পর্যন্ত যেত, এর সব কটিই পঞ্চগড় পর্যন্ত বর্ধিত করেন তিনি।

 

জমি বেচতে প্রকল্প নেন তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী

 

চাঁদপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি দীপু মনি আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে কারসাজির মাধ্যমে জমির উচ্চমূল্য নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সরকারের কাছ থেকে ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেওয়ার এই কারসাজিতে জড়িতরা দীপু মনির নিকটাত্মীয়।

জমি বিক্রি করে তিনগুণ লাভ করতে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মানিকগঞ্জে কারখানা স্থাপনে নেওয়া প্রকল্পের জায়গায় নিজের প্রতিষ্ঠান, মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের নামে জমি কিনে নেন তিনি। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। মূলত জমি বিক্রি করে লাভ করার উদ্দেশ্যেই তিনি সেখানে প্রকল্পটি করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন নিজের জমি বিক্রি করতে তার বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মালপাড়ায় আগে থেকেই একটি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) থাকলেও তিনি আরেকটি পিটিআই তৈরি করতে প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

 

এমপিদের লুটপাটের প্রকল্প

 

সংসদ সদস‍্যদের ইচ্ছে পূরণের জন্য নেওয়া হয়েছিল অগ্রাধিকারভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ‘পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প। এর আওতায় এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের ইচ্ছামতো উন্নয়ন করতে পারতেন। সেই সঙ্গে করতেন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই ব্যয়ের মধ্যে নানান অনিয়ম করেছেন সাবেক এমপিরা। যে কারণে প্রকল্পটি বাতিল করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।

সরকারের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাজশাহী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী এই প্রকল্পের অধীনে সড়ক সংস্কারের নামে টাকা তুলে নেন। কিন্তু কোথাও এক টুকরি মাটিও ফেলা হয়নি। এ ছাড়া আরও কয়েকজন এমপির নাম উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

 

আমলারাও কম যান না

 

শুধু মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা নন, প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন সচিবরাও। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলার পাতারচর এলাকায়। বাড়িতে যেতে তাকে মীরগঞ্জ এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদ পার হতে হয় ফেরিতে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে মীরগঞ্জে প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু অনুমোদন করিয়ে নেন তিনি। যার ব্যয় ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এই আমলা গণমাধ্যমে এই সেতুর অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার ক্রেডিট নেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব খায়রুল আলম তার বাবার নামে করেন জালালউদ্দিন ফাউন্ডেশন। কুমিল্লার দেবীদ্বারে অবস্থিত হাসপাতালটির জন্য ২০১৭ সালে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। ৫০ শয্যার হাসপাতালটির অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলেও এখনও চালু করা যায়নি।

সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ও বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ তার দাদা আহম্মদ উল্লাহ ও বাবা সালেহ আহমেদের নামে ফেনীর ফুলগাজীতে হাসপাতাল করতে ২০১৮ সালে অনুদান নেন ৩৯ কোটি টাকা। হাসপাতালটির অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ। তবে এখনও সেটি চালু হয়নি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব সাইদা নাইম জাহান মা-বাবার নামে নরসিংদীতে ছেতারা-ছফিউল্লাহ কিডনি ও প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেন। ২০১৯ সালে কেন্দ্রটির আওতায় ২০ কোটি টাকা অনুদান নেওয়া হয়। বাবা-মা ছাড়াও অনেকে নানা-নানির নামেও সরকারি টাকায় করেছেন হাসপাতাল। তাদের অন্যতম সাবেক সমাজকল্যাণ সচিব জুয়েনা আজিজ। নানা ও নানির নামে নোয়াখালীতে ফেরদৌস-মজিদ প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র ও হাসপাতাল করেন তিনি। ২০১৯ সালে অনুদান দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির চারতলা ভবন হয়েছে, সেবা এখনও চালু হয়নি।

শুধু সাবেক সচিবরাই নন, বর্তমান একজন সচিবও মন্ত্রণালয়ের টাকায় বাবার নামে হাসপাতাল করার জন্য ২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছেন।

Sharing is caring!