প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৯শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

সংসদ নাকি গণপরিষদ

editor
প্রকাশিত মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৯:৪৫ অপরাহ্ণ
সংসদ নাকি গণপরিষদ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সংযোজন-বিয়োজন, চার বছর মেয়াদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্যসহ সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। তবে এসব সুপারিশ কত সময়ের মধ্যে ও কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে মতবিরোধ।

নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। অন্যদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল মনে করছে সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটির কোনো রাজনৈতিক কারণও নেই। দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদই সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। তাদের দাবি, জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্যই গণপরিষদের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে।

সংস্কারবিহীন নির্বাচন কোনো কাজে দেবে না মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তাদের অবস্থান হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমেই সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় সংসদের মাধ্যমে সংস্কার টেকসই হবে না। ইতিহাসেও এটিই দেখতে পাই। এনসিপি গঠনের দিনও গণপরিষদের কথা বলা হয়েছে। তার পরেই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, যদি কোনো দেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে রাষ্ট্র সংস্কার, মেরামত বা পুনর্গঠন করতে হবে, সে ক্ষেত্রে সংবিধান সভা অথবা গণপরিষদ নির্বাচন আহ্বান করতে হয়। নির্বাচিত গণপরিষদ তর্ক ও বাহাসের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনগণের সামনে একটি খসড়া সংবিধান পেশ করে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ ওই সংবিধান অনুমোদন করার পর রাষ্ট্র গঠনের কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। তার মতে, সাধারণত বড় কোনো আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের পর এ ধরনের মুহূর্ত হাজির হয়। যদি প্রতীয়মান হয় যে বিদ্যমান সংবিধান গণ-অভিপ্রায়ের ধারক হতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা বিদ্যমান সংবিধানের মধ্য দিয়ে আর জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে না, তখন সংবিধান প্রণয়ন অথবা নিদেনপক্ষে সংস্কারের বিকল্প থাকে না। নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের এ মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তত দুবার (১৯৭২ ও ১৯৯১ সালে) এই ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পিছুটান ও রক্ষণশীলতার কারণে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রীকরণের আবশ্যিক কাজ হাতে নেওয়া যায়নি।

তবে রাজনৈতিক নেতা ও আইনবিদদের একাংশ বলছেন, যখন একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং সেই রাষ্ট্রের কোনো সংবিধান থাকে না, তখন একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়। কিন্তু আমাদের তো রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালে এবং আমাদের সংবিধানও রয়েছে। তাই গণপরিষদের যে ইস্যুটি তোলা হয়েছে তা অপ্রাসঙ্গিক। তারা বলেন, সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার জাতীয় সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারবে না, এটি করতে হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে। তাই বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই আগামী নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আর সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশে ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে অর্থাৎ সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত হবে।

 

বিশিষ্ট আইনবিদ অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান বলেন, বলা হচ্ছে গণপরিষদ নির্বাচন করবে, অর্ডিন্যান্স দিয়ে সংবিধান সংশোধন করবে। গণপরিষদের ইস্যুটি অপ্রাসঙ্গিক। নির্বাচন যাতে দ্রুত না হয় সে জন্য গোলমাল লাগাতে এখন এসব কথা বলা হচ্ছে। বিনা নির্বাচনে যাতে ক্ষমতায় থাকা যায় সে জন্য এই বক্তব্যগুলো সামনে আনা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যখন একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান থাকে না, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন। যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে সংসদ নির্বাচন হয়। তিনি বলেন, আমাদের তো স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান আছে। তবে এটির ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। বর্তমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে। তার জন্য গণপরিষদ নয়, একটি জাতীয় সংসদ দরকার।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চায়। এখন যদি সেটি না করে সরকার কোনো একটি দলের দাবি অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে যায় বা যাওয়ার চেষ্টা করে তা হলে দেশে রাজনৈতিক সংকট হবে। জাতীয় নির্বাচন বাদ দিয়ে কোনো দল সংবিধান ও গণপরিষদ নিয়ে চাপ দিলে তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। তখন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তার মতে এনসিপি সংবিধান সংশোধনসহ যেসব পদক্ষেপ নিতে চায় তারা সেই কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাবে। মানুষ যদি তাদের কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায় তা হলে তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে। তখন তারা যা করতে চাইবে তা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে করতে পারবে।

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, দেশে তো কোনো বিপ্লব হয়নি। হয়েছে গণঅভ্যুত্থান। তাই জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে হবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছে যে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তা পরীক্ষা দেওয়ার মতো। কারণ দলগুলোকে চয়েজ দিয়ে টিক দিতে বলা হয়েছে কোনটা চান কোনটা চান না সে বিষয়ে। তিনি বলেন, ৩৪টি দলের কাছে পাঠানো হয়েছে ঐকমত্যের জন্য। কিন্তু দেশের দুই থেকে তিনটি দলের প্রতি যদি দেশের সব মানুষের সমর্থন থাকে তা হলে শুধু ওই দুই বা তিনটি দলের ঐকমত্যের প্রয়োজন।

সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধান সংশোধন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হতে হবে। তা না হলে কোনো সংস্কারের সুপারিশই কার্যকর হবে না। যারা আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসবে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা বাস্তবায়ন না করলে জনগণের অর্থের অপচয় হবে এবং কমিশনের পণ্ডশ্রম হবে।

Sharing is caring!