
# গত ছয় মাসে দাম বেড়েছে তিন দফায়।
# কেজিতে ৮-১০ টাকা বৃদ্ধি।
# রোজার মধ্যেও বেড়েছে ২-৩ টাকা।
# গত বছরের তুলনায় এই দাম ১৩ শতাংশ বেশি।
# গুদামে শুধু চালের মজুতই ১০ লাখ টন।
প্রজন্ম ডেস্ক:
বাজারে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। যদিও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চালের ব্যাপক আমদানি হচ্ছে এবং এতে সরকারি গুদামে মজুত আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাবই পড়ছে না। কমছে না চালের দাম। বরং গত কয়েক সপ্তাহে কিছু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে চালের দাম এখনো ১৩ শতাংশ বেশি। আর ব্যবসায়ীরা পূর্বাভাস রেখে বলেছেন, বাজারের এই ঊর্ধ্বগতি আরও কিছুদিন থাকবে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ধানের নতুন ফলন বাজারে এলে তখন দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যাপক আমদানি ও সরকারি মজুত
গত বছর যেখানে চালের আমদানি ছিল না, সেখানে এবার সরকার ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম থেকে বিপুল চাল আমদানি করছে। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকেও চাল সংগ্রহ চলছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে চালের মজুত ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে মোট খাদ্য মজুত ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে। বেসরকারি পর্যায়ে গত আট মাসে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১০ লাখ টন চাল ও গম আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৬ লাখ টন চাল আমদানি অনুমোদন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৬ লাখ ২৪ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে এবং আমন মৌসুম থেকে সরকার ৫ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল সংগ্রহ করেছে।
বাজারের বাস্তবতা ও মূল্য পরিস্থিতি
এত বেশি মজুত থাকার পরও চালের বাজারে মূল্যহ্রাসের প্রভাব পড়ছে না। বরং রোজার আগে চালের দাম কয়েক দফা বেড়েছিল এবং রোজার পরেও কিছু কিছু চালের দাম আরও ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে ভালো মানের সরু চালের দাম প্রতি কেজি এখন ৮০ থেকে ৯০, মাঝারি মানের চাল ৭০-৭৬ এবং মোটা চাল ৫৮-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের প্রদত্ত তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে তিন দফায় চালের দাম বেড়েছে এবং প্রতি কেজিতে গড়ে ৮ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধানের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাউসার আজম বলেন, গত বোরো মৌসুমে মিনিকেট ও জিরাশাইল ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় সরু চালের সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে এবং কৃষকদের মজুতও শেষ হয়ে গেছে। তবে আশা করা হচ্ছে, বৈশাখে নতুন বোরো ধান বাজারে এলে চালের দাম কমবে।
বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এ এম লায়েক আলী বলেন, ‘বর্তমানে ধানের মজুত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, তাই স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। এর ফলে চালের দামও বেড়েছে। তবে বোরো ধান ওঠার পর ধানের দাম কমলে চালের দামও কমবে।’
দামের পরিবর্তন কবে
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে চালের দাম কমতে শুরু করবে। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বোরো মৌসুমের নতুন ধান বাজারে আসবে, যা বাজারে চালের সরবরাহ বৃদ্ধি করবে এবং মূল্য নিম্নমুখী করবে। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, মৌসুমের পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনের পর চালের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ১০ টাকা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি মজুত ও খাদ্যনিরাপত্তার হিসাব
চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের মজুত বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খানের মতে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বছরে মোট উৎপাদনের অন্তত ১০ শতাংশ চাল মজুত রাখা দরকার, যা হওয়া উচিত ৪০ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে ১০ লাখ টনের কিছু বেশি চাল মজুত থাকলেও তা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশে প্রতি মাসে ২৫ লাখ টন চালের চাহিদা থাকায় খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অন্তত সাড়ে ১২ লাখ টন চাল সার্বক্ষণিক মজুত রাখা প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ
চালের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ চরম সংকটে পড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, ভোক্তারা কম পরিমাণে চাল কিনছেন, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। রাজধানীর বাজারে ভালো মানের মিনিকেট চালের দাম ৮৬ থেকে ৮৮ টাকা কেজি, বড় ব্র্যান্ডের মিনিকেট ৯০ থেকে ৯২ টাকা কেজি এবং সাধারণ মোটা চাল ৫৮ টাকা কেজি। রামপুরা বাজারের কুমিল্লা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা কামাল মোহসিন জানান, এক সপ্তাহে আবারও কেজিপ্রতি দুই টাকা বেড়েছে। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না, তবে নতুন বোরো ধান এলে দাম কমবে এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে।
সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সরকার ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে খোলাবাজারে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সরবরাহের অভাবে এর কার্যকারিতা সীমিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে তদারকি বাড়ানো, ব্যবসায়ীদের মজুতের ওপর নজরদারি ও সরাসরি ভোক্তাদের কাছে সুলভ মূল্যে চাল পৌঁছানো প্রয়োজন। এ ছাড়া আমদানি কার্যক্রম সহজ করে সরবরাহ বাড়াতে হবে।
Sharing is caring!