প্রজন্ম ডেস্ক:
শেখ হাসিনার সরকারের পতন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনায় ছিল পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৬ শ মানুষ।
এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১৮ হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতির কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনী সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় এ সংস্কার হবে সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ বাহিনীর মোট জনবলের অর্ধেকের বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। নিয়োগের সময় রাজনৈতিক মতাদর্শকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতেন।
এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের হেভিওয়েটদের সঙ্গে তাদের সখ্য তৈরি হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ওই পুলিশ কর্মকর্তারা অধস্তনদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে। পরে সরকারের পতনের পর তারা সটকে পড়েন। তবে নিচু সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা (কনস্টেবল-পরিদর্শক) জনগণের রোষানলে পড়েন। তাদের ওপর হামলা হয়। মারা যান ৪০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য। এসব কারণে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হবে বলেও অন্তবর্তী সরকারের এক উপদেষ্টার পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস
১৮৬১ সালে ‘দ্য কমিশন অব দ্য পুলিশ অ্যাক্ট’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়। ওই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। রাজ্য পুলিশ প্রধান হিসেবে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ পদ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসেবে সুপারিনটেনটেন্ড অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের পুলিশের নাম প্রথমে ‘ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ’ রাখা হয়। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’ নাম ধারণ করে। একাত্তরের পর বাংলাদেশ পুলিশ নামে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি রঙের। ২০০৪ ও ২০১৬ সালে পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙ পরিবর্তন করা হয়েছিল। মহানগর ও জেলা পর্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেওয়া হয়েছিল। আবার পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতা রয়েছে। পুলিশের এসব সংস্কারে বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের বর্বরোচিত ভূমিকা এ বাহিনীর সংস্কারের প্রয়োজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এরই মধ্যে পুলিশের পোশাক ও মনোগ্রাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। তবে পুলিশ বাহিনীর মূল সমস্যা হলো বাহিনীটির রাজনীতিকীকরণ। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) পদে যথাক্রমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৯২৫ এবং সাড়ে ১১ হাজার। এ থেকে বোঝা যায়, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অর্ধেকের বেশিই নিয়োগ হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে আলোচনা রয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীর দলীয়করণের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরের সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী শক্তি দমনে পুলিশ বাহিনী হাতিয়ারে পরিণত হয়।
বিরোধীদের দমনের জন্য গত প্রায় ১৬ বছরে দেড় লাখ মামলায় বিএনপির ৫০ লাখ লোককে আসামি করা হয়। ফলে দলটির রাজপথে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ে। গত ৩ সরকারের আমলে পুলিশের শতশত গায়েবি মামলা আলোচনায় আসে। এসব মামলার সূত্র ধরে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু হয়। গুম-অপহরণসহ আলোচিত নানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশে দলীয়করণের বিষয়টি জনসমক্ষে স্পষ্ট হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ আলোচনা-সমালোচনা বাড়তে থাকে। এভাবেই পুলিশ বিতর্কিত হয়। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রায় সাড়ে ছয় শ জনকে হত্যার ঘটনা এখন ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও জনরোষের মুখে পড়ে। এ কারণে সংস্কার করে একে সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করার দাবি ওঠে।
এদিকে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন বাহিনীটির অভ্যন্তরীণ বৈষম্য নিরসনের দাবি উঠেছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে নিহত পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগই কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার। তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছেন। বাহিনীর অতি উৎসাহী ওই কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে নিচের সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তারা নানাভাবে সুবিধা ভোগ করেছেন। কিছু কর্মকর্তার কাছে পুরো বাহিনী জিম্মি ছিল। অনিয়মের মাধ্যমে তারা অর্থবৈভবের মালিক হয়েছেন। সময় বুঝে তারা এখন সটকে পড়েছেন। তাই নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন দাবি করে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের দাবি পূরণে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া আইজিপি ময়নুল ইসলাম।
ঊর্ধ্বতনদের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলামও। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন।’
পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে
এদিকে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রসঙ্গে মত দিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু এটা এখনো প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। আগে অপরাধীরা পুলিশকে ভয় পেত কিন্তু এখন ভালো মানুষ ভয় পায়।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্যানে লাশের স্তূপের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। পুরো বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন। যখন যারা ক্ষমতায় ছিল এই বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া পুলিশের মধ্যে একটা তাড়না আছে নিজেদের সংস্কারের বিষয়ে। তারা বুঝতে পারছে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে অনেক কাজ করতে হবে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আপনি ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ চালাচ্ছেন। ব্রিটিশরা কি বাংলাদেশে এসেছিল জনমুখী একটা পুলিশ দিতে? তা তো তারা আসেনি। সবকিছুই আলোচনা হয়েছে, পুলিশ কমিশন যখন হবে, যখন জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো আমরা পাব, সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে যাতে একটা জনবান্ধব পুলিশবাহিনী গড়ে তুলতে পারি সেটাই আমাদের ইচ্ছা।’
পুলিশ সদস্যদের ট্রমা কাটছে না
বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারি হিসেবে ৪০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ সময় দেশব্যাপী সাড়ে ৪ শর মতো থানা, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়েছে। কাজে ফিরলেও পুলিশ সদস্যরা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে জনরোষে পড়ার ভয়ে সতর্কতার সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। কারও কারও কর্মস্পৃহাও কমে গেছে। আবার পুলিশের একটি অংশ যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা মামলা ও হামলার আতঙ্কে আছেন। তৎকালীন আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং হচ্ছে।
অন্যদিকে যারা মাঠপর্যায়ে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বেশি শঙ্কা কাজ করছে। কারণ আন্দোলন দমন করতে তারা গুলি ছোড়াসহ অনেক শক্তি প্রয়োগ করেছেন। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশের ওপর বড় ধরনের ধকল গেছে। এটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে ৪২ জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ১১৭ জন। অনেকেই এখনো রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কর্মক্ষেত্রে ফিরতে তাদের অনেক সময় লাগবে। তবে কর্মকর্তারা আশা করছেন, সংকট দ্রুতই কেটে যাবে এবং পুলিশ আগের মতো জনসেবা শুরু করবে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এটা দূর করতে পুলিশকে প্রেরণামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজশাহীর সারদায় পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিযুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিআইজি জানান, আন্দোলন দমনে নিচু সারির সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা শুনতে বাধ্য হন। কথা না শুনলে তাদের চাকরি থাকবে না, বিধায় তারা বাধ্য হয়ে শক্তি প্রয়োগ করেছেন। অনেকেই সরাসরি গুলি করতে বাধ্য হয়েছেন। এসব পুলিশ সদস্য বেশি ট্রমায় ভুগছেন। তিনি দাবি করেন, দীর্ঘদিন সরকার পরিবর্তন না হওয়ার কারণে পুলিশের মধ্যে একটি গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এতে কিছু পুলিশ সদস্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
সংবাদটি শেয়ার করুন।