প্রজন্ম ডেস্ক:
অনিয়ম ও দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশা করা হলেও বাস্তবে তা পূরণ করতে পারেনি সংস্থাটি। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনতে চায় তারা।
প্রভাবশালীদের বদলে চুনোপুঁটি ধরে সমালোচিত হওয়া দুদক গত মে ও জুন মাসে আলোচিত কয়েকজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। যার মধ্যে রয়েছে ‘ছাগল কাণ্ডে’ নাম আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। এছাড়া করোনা রিপোর্ট জালিয়াতি কাণ্ডে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবুল কালাম আজাদ, সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের নামে মামলা করেছে দুদক। মধ্য জুলাই থেকে দুদকের কার্যক্রমে কিছুটা ধীর গতি দেখা যায়। এসময় কমিশনের মামলা, অভিযোগপত্র কিংবা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত ছিল কম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর থেকে বড় পরিবর্তন এসেছে সরকার এবং ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন নয়তো বদলি করে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে অন্যদের আনা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুদকের শীর্ষ পদে থাকা তিন কর্মকর্তাকে (চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার) নিয়েও শুরু হয়েছে গুঞ্জন। যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, দুদকের শীর্ষ পদে নিয়োগ অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ভিন্নতর ও সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বর্তমান কমিশনকে রেখেই দুর্নীতি দমন কার্যক্রম চালাতে চায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তবে দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার ও সচিবকে পদত্যাগের জন্য আলটিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধান দলে আরও রয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও মো. নাছরুল্লাহ হোসাইন।
আসাদুজ্জামান খান ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন মন্ত্রীর সাবেক পিএস ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) একাধিক প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসব তথ্য পাওয়া গেলে আরও প্রভাবশালীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে পারে দুদক।
জানা গেছে, দুদকের তদন্ত দলকে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি সরবরাহ করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে অভিযুক্তদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করার নির্দেশনা রয়েছে।
এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আসাদুজ্জামান খান ও তার সহযোগীরা সিন্ডিকেট করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে নিয়োগ দিতেন। আসাদুজ্জামান খান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুস হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা আদায় করা হতো। এজন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও এই মন্ত্রণালয়ের সব ঘুস দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে।
এছাড়া অনুসন্ধান শুরু হয়েছে আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) ও পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে। এই দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। এস আলমের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসিন আরাফাতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) একাধিক প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসব তথ্য পাওয়া গেলে আরও প্রভাবশালীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে পারে দুদক। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, সাবেক ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী প্রমুখ।
যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বাড়ি রয়েছে এমন অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। সোবহানের সম্পদ অনুসন্ধানে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট’ (এমএলএআর) করেছে দুদক।
পদত্যাগ সমাধান নয়
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বেশ কিছুদিন অফিস করেননি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন। তবে গত ১৪ আগস্ট থেকে তারা অফিস করছেন।
আরেকটি সূত্রের দাবি, গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন এই তিন কর্মকর্তা। দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রম আরও শাণিত করতে একমত হয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার কথাও ভাবছেন তারা।
তবে দুদকের কার্যক্রমে কোনো স্থবিরতা বা চাপ নেই বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাভাবিক কাজটাই করে যাচ্ছি। আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করছে কমিশন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক মহাপরিচালক বলেন, ‘দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ অন্য সংস্থার মতো নয়। এখানে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা সময় সাপেক্ষ।’
দুদক আইন ২০০৪ অনুযায়ী, কমিশন তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন। এই শীর্ষ কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ধারা ৭ অনুসারে গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে পাঁচজন সদস্য সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। যার মধ্যে রয়েছে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; বাংলাদেশের মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
দুদকের ওই মহাপরিচালক বলেন, দুদক আইনে দুই কমিশনার ও চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা ছাড়া পুরো কমিশন অচল। এখন নতুন কমিশন আনা সময়সাপেক্ষ। কারণ এতে দীর্ঘদিন দুদকের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে, তাতে দুর্নীতিবাজরাই লাভবান হবে।
ব্যক্তির পরিবর্তন না করে দুদকের আইন ও বিধি পরিবর্তনের তাগিদ জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশনার ও চেয়ারম্যান নিয়োগে স্বচ্ছতা নেই। কমিশনের নিজস্ব প্রসিকিউশন নেই, মানিলন্ডারিং আইনের অনেক ধারা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া দুদক আইন ২০০৮ এর ৫৪/২ ধারার মাধ্যমে সৎ কর্মকর্তাকে শিকল বন্দি করে রাখা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে- ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারবে।’
দুদকের আইন ও বিধিতে সংস্কার আনতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দুদকের ভেতরেই প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সর্ষের মধ্যে ভূতটা তাড়াতে হবে। দুদক আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। দুদককে পুনর্গঠন করতে হবে। দুদককে ঠিক করে দিলে তারা অটোপাইলটে চলে যাবে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবে। দুর্নীতি রোধে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে; না হলে জনগণ ও ছাত্র যারা এত রক্ত দিল এরা ভীষণভাবে হতাশ হবে।’
দুদকেও সংস্কার প্রয়োজন জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে প্রত্যাশিত নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।’
সংবাদটি শেয়ার করুন।