প্রজন্ম ডেস্ক:
সরকার পরিবর্তনের পর সারা দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী (একনেক) কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) কাটছাঁট করা হবে বলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন।
পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকারকে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন কোনো সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাতিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার কার্যক্রমও একেবারে থমকে গেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগপন্থি ঠিকাদাররা এখনো ভয়ে-আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ (সওজ), সিটি করপোরেশনসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতেও একধরনের আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। কারণ ইতোপূর্বে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচিত। ফলে তারা আতঙ্কে আছেন। অন্যদিকে বেশির ভাগ ঠিকাদারও আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক থাকায় তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের ভিত্তিতে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন করা হয়। কিন্তু প্রকল্প কাটছাঁট করার ক্ষেত্রে এখনো তারা কোনো গাইডলাইন বা বিজ্ঞপ্তি পাননি। শুধু পরিকল্পনা উপদেষ্টার মৌলিক নির্দেশনায় কোনো রকমে কাজ করছেন। কখন একনেকের সভা হবে, তাও কেউ বলতে পারছেন না। কারণ আগের সব প্রকল্প যাচাই করে পর্যালোচনা সভা করার পর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করতে হবে। তারপর একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে। এসব প্রক্রিয়ায় আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব সোলেমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বরং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তার কথা অনুযায়ী পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ত থাকায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
২ জুলাইয়ের পর একনেকের কোনো সভা হয়নি
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দেশের উন্নয়নে গত ৯ নভেম্বর একনেকের সভায় ৪৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরপর অনুষ্ঠিত একনেকের প্রায় সব সভায় কমপক্ষে ১০টি প্রকল্প পাস হয়েছে। সর্বশেষ গত ২ জুলাই শেখ হাসিনা সরকারের শেষ একনেক সভায় ১১টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এরপর গত ৫ জুলাই থেকে ছাত্ররা কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তারপর শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এতে প্রথমে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পরে উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হলে গত ১৬ আগস্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার চার দিন পর ১৯ আগস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন।
এদিকে গত ১৪ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকারের নিয়োগ বাতিল করা হয়। ফলে সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য (সচিব) আবদুল বাকী। সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘জিডিপি বাড়ানোর চেয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রকল্প যাচাই-বাছাই করাও খুব প্রয়োজন। কারণ এখানে অনেক বিশৃঙ্খলা রয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আবার পর্যালোচনা করা হবে, ছাঁটাই করা হবে।
এডিপি থেকে বাদ পড়তে পারে লাখ কোটি টাকা
প্রকল্প প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা সভায় প্রকল্প কাটছাঁট বা বাতিলের কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত নির্দেশনা হাতে পাওয়া যায়নি। তার পরও একনেক অধিশাখা থেকে অসংখ্য প্রকল্প ফেরত দেওয়া হয়েছে। সেগুলো ভৌত অবকাঠামো বিভাগ, শিল্প ও শক্তি বিভাগ, আর্থসামাজিক বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কয়েকটি বাতিল করে ফেরত দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। শেখ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কোনো প্রকল্প বা রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়েছে, এমন প্রকল্প বাদ দেওয়া হচ্ছে। আবার কম গুরুত্বপূর্ণ এবং ম্যুরাল, মূর্তি তৈরির প্রকল্প থাকলে তা বাতিল করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে এডিপি থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বাদ দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে।
এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছরের শুরু থেকেই দেশে অস্থিরতা চলতে থাকায় উন্নয়নকাজ ঝিমিয়ে পড়ে। ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গত জুলাই মাসে মাত্র ১ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। যেখানে আগের বছরের জুলাইয়ে ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সক্ষম হয়েছিল।
পরিকল্পনা সচিবের পদটি এখনো খালি রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে কয়েকজন নতুন সদস্য (সচিব) নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু তারা কথা বলতে নারাজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সদস্য বলেন, আগে যা-ই হোক না কেন, এখন থেকে পরিকল্পনা কমিশনে সব প্রকল্পেরই পর্যালোচনা সভা করতে হবে। সেখানে যাচাই-বাছাইয়ের পর কাটছাঁট হয়ে যাবে অনেক প্রকল্প। তারপর যা থাকবে সেগুলোর বিষয়ে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে পর্যবেক্ষণ করার পর অনুমোদনের উপযোগী হলে উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হবে। আর প্রকল্প ৫০ কোটি টাকার ওপরে হলে একনেক সভায় যাবে সরকারপ্রধানের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী একনেক সভা হতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বদলি-আতঙ্কে কর্মকর্তারা, নতুন করে হয় না টেন্ডার
গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক পরিবহন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি সব কেনাকাটা ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি)’-এর মাধ্যমে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের ফলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব অফিসে বদলি-আতঙ্কে আছেন কর্মকর্তারা। ঢিলেমিভাবে চলছে কাজ। অনেকেই মুখ খুলে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। ফলে টেন্ডার কার্যক্রমও একেবারেই কমে গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে এক্সচেঞ্জ অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। এই প্রতিষ্ঠানের ঢাকা জেলা অফিসে যোগাযোগ করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফিরোজ আলম তালুকদার বলেন, ‘উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি কমে গেছে। যা কাজ হচ্ছে সেগুলো আগের অনুমোদন করা প্রকল্পের কাজ। টেন্ডার খুবই কম হচ্ছে, যা হচ্ছে ই-জিপির মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরে কোনো প্রকল্প অনুমোদন হলে জিও (সরকারি আদেশ) জারি, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসহ সব প্রক্রিয়া শেষে তার টেন্ডার হতে তিন-চার মাস লাগতে পারে।
এ সময় রেজা উদ্দিন নামে এক ঠিকাদার বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের ফলে স্যারদের মধ্যে বদলি-আতঙ্ক কাজ করছে। এ জন্য অনেকে ঠিকমতো অফিসে আসেন না। এলেও অফিসে থাকেন না। নতুন কোনো টেন্ডার হয়নি। আগের টেন্ডারের কাজই করা হচ্ছে। এটা লটারির মতো। দেখা যায়, ২০০ টেন্ডারে অংশ নিলে হয়তো পাঁচটি ভাগ্যে জোটে। অনেকেই যারা আওয়ামী লীগপন্থি ঠিকাদার তারা ভয়ে-আতঙ্কে আত্মগোপনে আছেন।’
জাহিদসহ অন্য ঠিকাদাররাও বলছেন, ‘কোনো কাজ নেই। অফিসে এলেও অফিসারদের ঠিকমতো পাচ্ছি না। বিলও আটকে থাকছে। সরকারি অফিসে একেবারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অফিসেও দেখা গেছে একই অবস্থা। এই অফিসে অনেক লোকের সমাগম দেখা দিলেও ঠিকাদারি থেকে শুরু করে অর্থ পরিশোধ সব এক্সচেঞ্জ অফিসে হয়। তাই রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মহাখালী গণপূর্ত বিভাগ, সাভার গণপূর্ত বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে যোগাযোগ করলে কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাজ একেবারে থমকে গেছে। টেন্ডার হচ্ছে না। নতুন করে একনেক সভা না হওয়া পর্যন্ত কাজে গতি আসবে না।
এ সময় এনএন এন্টারপ্রাইজের মো. রাসেল হাওলাদার বাচ্চু এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকার বদলের পর কাজে একেবারে স্থবিরতা চলছে। সর্বশেষ গত জুনে টেন্ডার হয়েছে। সে সময়ে একটা কাজ পেয়েছি। কিন্তু পেমেন্ট পাচ্ছি না। সে জন্য অফিসে আসা। কিন্তু স্যারদের সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তারা বদলি-আতঙ্কে এখান-ওখান ছোটাছুটি করছেন। এ জন্য ঠিকমতো অফিসে আসেন না। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে এই ঠিকাদার বলেন, ‘ই-জিপিতে টেন্ডার হলেও অফিসে আসতে হয়। পুরোনো প্রকল্পের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। নতুন করে একনেক সভা না হলে কাজ আসবে না। হাত গুটিয়েই চলতে হবে। অনেক ঠিকাদারই আসছেন না।’
সরকারি সব কেনাকাটা ই-জিপিতে হয়। বর্তমানে কেমন হচ্ছে, তা জানতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি অফিসে না আসায় ও ফোন বন্ধ থাকায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অন্য এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগের মতো কোনো টেন্ডার হয় না। কারণ হচ্ছে সরকার পরিবর্তনের পর নতুন অর্থবছরে কোনো প্রকল্প অনুমোদন হয়নি।
সংবাদটি শেয়ার করুন।