প্রজন্ম ডেস্ক:
বিগত কয়েক বছর দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। বিভিন্ন সময় নানাভাবে এই অর্থ পাচার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলার-সংকট যত প্রকট হয়েছে, ততই অর্থ পাচারের বিশালতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হালনাগাদ প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মোট পুঞ্জীভূত পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কখনও বেনামী এবং ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাৎ করে, কখনও ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের সুযোগ নিয়ে অর্থ পাচারের পথ খোলা হয়েছে। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও একটি চক্র টাকা পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সবকিছুই জানত। দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় স্বীকারও করতেন। তবে এই অর্থ পাচারের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি মহলের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় তখন পাচারকারীদের শনাক্তে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এভাবেই নীরবে দেশ থেকে অর্থ পাচারের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল।
এখন সরকারের ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। অর্থ পাচার নিয়ে নানা মহলের আলোচনা নতুন করে উঠছে। একই সঙ্গে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ তাঁর সহচরদের দ্বারা বাংলাদেশ ব্যাংকে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিও টেনে আনা হচ্ছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরাই এখন সব বিষয় সামনে আনছেন। তাঁরা ক্ষোভও প্রকাশ করছেন। দাবি করছেন পদত্যাগেরও। একটা পর্যায়ে গতকাল বুধবার গভর্নরের অন্যতম সহচর হিসেবে পরিচিত বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানসহ আরও দুই গভর্নরের পদত্যাগ করাতে বাধ্য করেন ক্ষুব্ধ ব্যাংক কর্মকর্তারা। তবে কাজী সাইদুর রহমান ছাড়া অন্যরা কোনো লিখিত পদত্যাগপত্র দেননি। হদিস নেই গভর্নরসহ অনেকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, গভর্নরের বিষয়ে জানা নেই। ডেপুটি গভর্নর এবং বিএফআইইউ প্রধানদের পদত্যাগের বিষয়ে দাবি তুলেছেন কিছু ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খেলাপি এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএফআইইউয়ের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সংস্থাটির কাজ অর্থ পাচার রোধ করা। কিন্তু একার পক্ষে সম্ভব না। পাচারকারী ধরার মতো আইনি এবং কাঠামোগত সক্ষমতা নেই তাদের। পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশন, ব্যাংক এবং কাস্টমস বিভাগের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ব্যবসায়িক লেনদেনকালে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশের ঋণ ও করখেলাপি এবং অর্থ পাচার একই সূত্রে গাঁথা। ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকে অর্থের টান পড়েছে। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব দর্শকের ভূমিকার কারণেই এগুলো বেড়েছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার ফলে জাতি আজ অনেক কিছু দেখছে। তিনি এ পরিস্থিতির উত্তরণে দ্রুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সম্ভাব্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খেলাপি ঋণ আদায় এবং পাচার রোধ এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার-সংকট দেখা দিলে পাচার কমাতে বিশেষ কমিটি গঠন করে। বিশেষ করে আমদানি এবং রপ্তানি করা পণ্যের অনলাইন দর মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার প্রায় ৯৩ শতাংশ কমে এসেছে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ ছাড়া ব্যাংকের ঋণের নামে অর্থ লুট ঠেকাতে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে শর্ত আরোপ এবং হুন্ডি ঠেকাতে খোলাবাজারে ডলারের দর নির্ধারণসহ বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কিন্তু তত দিনে অর্থ পাচার বেসামাল হয়ে পড়ে। সরকারের বিশেষ মন্ত্রী, ঘনিষ্ঠজন ও একটি বিশেষ গ্রুপকে বাঁচাতে হাত-পা গুটিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ের মতো সংস্থাগুলো।
এ বিষয়ে বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিএফআইইউর একার পক্ষে পাচার রোধ করা সম্ভব না। পাচার রোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এবং কাস্টমস বিভাগের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে পাচার বেড়ে গেছে। এমনকি ব্যবসায়িক লেনদেনকালে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে।
বাংলাদেশে অর্থের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনটির নাম ছিল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২। এ আইনের বিধানাবলি অপর্যাপ্ত থাকায় ২০০৮ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। পরে লন্ডারিং আইন-২০০৯ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ নামেই পরিচিত।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থ পাচার রোধে দুটি প্রক্রিয়া উল্লেখ্য। প্রথমটি প্রতিকারমূলক এবং অর্থ ফেরত আনা। কিন্তু সংস্থাগুলো ঠিকমতো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সূত্র জানায়, দেশে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফের হিসাবে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের পুনঃ পুনঃ পুনঃ তফসিলের কারণে ব্যাংক খাতে অর্থের টান পড়েছে।
সংবাদটি শেয়ার করুন।